“হত্যা করা হয় শতাধিক হিন্দু পরিবারের দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতিসহ শিশু-কিশোরকে” “এক বছরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি দুই বছরেও”.
আজ ১৭ এপ্রিল দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর লোমহর্ষক আঁখিরা গণহত্যা দিবস। ৫২ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদিপুর ইউনিয়নের বারাইহাট থেকে এক’শ মিটার অদূরে আঁখিরা নামক স্থানের পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি খানসেনাদের হাতে প্রাণ হারান ভারতে আশ্রয় নিতে যাওয়া ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও বদরগঞ্জ উপজেলার শতাধিক হিন্দু পরিবারের দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতিসহ শিশু-কিশোর। আজও অনেকে এ ঘটনার বেদনাবিধূর লোমহর্ষক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন।.
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি খানসেনা ও তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-সামসদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মুক্তিকামী মানুষ ফুলবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পথে ভারতে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আজকের এই দিনে ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকার পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলার আফতাবগঞ্জ, বিরামপুর, পার্বতীপুরের শেরপুর, ভবানীপুর, বদরগঞ্জ ও খোলাহাটিসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক হিন্দু পরিবারের দেড়শতাধিক নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতিসহ শিশু-কিশোর-কিশোরীকে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ফুলবাড়ীতে নিয়ে আসে। এরপর রাজাকার কেনান সরকার অস্ত্রের মুখে হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই নিরস্ত্র বাঙালি পরিবারগুলোর সঙ্গে থাকা অর্থ সম্পদসহ স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে তুলে দেয় খানসেনাদের হাতে। ওইদিন সকাল ১১টার দিকে আঁখিরা পুকুর পাড়ে নিয়ে সবাইকে লাইনে দাঁড় করে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে হত্যাযজ্ঞ চালায় খানসেনারা।.
এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তবে দেশ স্বাধীনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কুখ্যাত রাজাকার কেনান সরকারের মৃত্যু হয়।.
প্রত্যক্ষদর্শী সেই সময়ের ৮ বছরের বালক বারাইহাটের মোসলেসুর রহমান জানান, লুকিয়ে থেকে খানসেনাদের হত্যাযজ্ঞ দেখার অপরাধে এলাকার ৮ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে খানসেনারা। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষের লাশ। পুকুরপাড় এলাকায় স্বাধীনতার পরও মানুষের হাড়গোড়সহ মাথার খুলি পড়ে ছিল।.
এদিকে এই লোকহর্ষক গণহত্যার ৫০ বছর পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি’র প্রচেষ্ঠায় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের “১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি সমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়ে) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সেই বধ্যভূমিতে গত ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৭ টাকা। একই বছরের ডিসেম্বর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটি শেষ হয়নি। ফলে অর্ধ সমাপ্ত ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে নির্মাণাধিন স্মৃতিস্তম্ভটি। .
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকারি ঠিকাদার বাদল বলেন, দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগের তত্বাবধানে ২০২১ বছরের ১৩ জানুয়ারি আঁখিরা পুকুর পাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। একই বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজের ডিজাইন পরিবর্তনের কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ করা যায়নি।.
গণপূর্ত বিভাগের ফুলবাড়ীর দায়ীত্বরত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ইমরান রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে হলে অফিসে গিয়ে দেখা করে সরাসরি বলতে হবে। মোবাইল ফোনে কোনো কথা বলা যাবে না।.
সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার লিয়াকত আলী ও ডিপুটি কমা-ার এছার উদ্দিন বলেন, স্থানীয় সাংসদের প্রচেষ্ঠায় এই বীর শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পাকিস্তানি খানসেনাদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস জানাতে আঁখিরা বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেখানে এই দিনে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারি শহীদদের নিয়ে স্মৃতি চারণ করা হবে।.
ডে-নাইট-নিউজ / প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:
আপনার মতামত লিখুন: