প্রবাদ আছে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই যার যথার্থ প্রমাণ মিলেছে গাড়ি চোর সিন্ডিকেটের অবিশ্বাস্য কারসাজিতে। চোর সিন্ডিকেটকে সহায়তা করেছেন খোদ ডিবি পুলিশের একজন পরিদর্শক (ইনস্পেকটর)।.
বাদ যাননি আদালতের সংশ্লিষ্ট সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর। নিলামের মাধ্যমে বৈধতা দিতে চক্রটি রীতিমতো চোরাই গাড়ির ব্যবসা খুলে বসেছে। চোরাই গাড়ি উদ্ধার করতে নেমে এমন অলিখিত হাট বসানোর তথ্য পেয়েছেন মিরপুর ডিবির গোয়েন্দারা। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য উঠে এসেছে।.
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চোর সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় চুরি হওয়া ১১টি গাড়ি জব্দ করা হয় ডিবির অনুসন্ধানে। এ গাড়িগুলো নিলাম দেখানো হয় হবিগঞ্জের একটি আদালতে। সংশ্লিষ্ট আদালতের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটরের সহায়তায় নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে চোরাই গাড়ি নিলাম দেখিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন গাড়ি চোর সিন্ডিকেটের মূল হোতা তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেক, ডিবির ইনস্পেকটর (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলাম এবং আদালতের কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন।.
সম্প্রতি ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর চশমা তারেক চোর সিন্ডিকেটের বিস্তারিত তুলে ধরে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। এছাড়া চশমা তারেক ও স্ট্যানোগ্রাফার আল আমিন একে অপরকে সহযোগিতা করার কথা প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। তাদের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে চোর সিন্ডিকেটের ভয়াবহ চিত্র।.
যেভাবে চোরাই গাড়ি উদ্ধার : উত্তরা ১১নং সেক্টরে বসবাসকারী বিকাশ চন্দ্র সরকার ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গাড়ি পার্কিং করে বাজার করতে যান। ফিরে এসে দেখেন তার গাড়িটি নেই। এ সময় গাড়িচালকও তার সঙ্গে ছিলেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে গাড়িটি চুরি হয়। এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়। তবে কাফরুল থানায় দয়ের করা আরেকটি গাড়ি চুরির মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহাদাত আলম ওই বছরের ১৩ মার্চ আব্দুল আলীম ইমনকে গ্রেফতার করেন। তার কাছ থেকেই চোরাই দুটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ইমনের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাধবপুরের কৃষ্ণনগর থেকে জজ মিয়ার ছেলে উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় পাঠান এবং হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেলের সামনের ফার্মেসি থেকে মহিউদ্দিনের ছেলে এএইচ রুবেলকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে গ্রেফতার করা হয় গাড়ি চোরচক্রের মূল হোতা তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেককে।.
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ডিবি মিরপুর জোনের গোয়েন্দারা এই চক্রের কাছ থেকেই ১১টি গাড়ি উদ্ধার করেন। এসব গাড়ি হবিগঞ্জের একটি আদালতে নিলামে দেওয়ার জাল নথিপত্রও উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন হবিগঞ্জের সাবেক ডিবি ইনস্পেকটর (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলাম মানিক। ওই পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন চশমা তারেক। গাড়ি চোর ও মাদক ব্যবসায়ী চশমা তারেক রীতিমতো ডিবি ওসি মানিকুল ইসলামের ওয়্যারলেস কোমরে রেখে নিজেই ইনস্পেকটর পরিচয় দিতেন। গাড়ি চুরি আর মাদকের টাকায় মানিকুলও এখন কোটিপতি। হবিগঞ্জে চাকরি করেছেন এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা চাঞ্চল্যকর এই তথ্য দেন। গাড়ি চুরির বিষয়ে ডিবির গোয়েন্দারা ভয়াবহ তথ্য উদ্ঘাটন করলেও সেখানে মানিকের নামই নেই। অথচ মানিক তার ওয়্যারলেস সেট নিয়ে অপব্যবহার করেছেন। নিজের ব্যবহৃত সরকারি ওয়্যারলেস সেট চশমা তারেকের হাতে দিয়ে ছবিও তোলেন, যা চাকরির শৃঙ্খলাপরিপন্থি কাজ।.
জানা যায়, হবিগঞ্জ শহরের তিনকোনা পুকুরপাড় এলাকায় তারেকের এটি চশমার দোকান রয়েছে। মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে চশমা ব্যবসার আড়ালে গড়ে তোলা হয় চোরাকারবারিদের বিশাল সিন্ডিকেট। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার একাধিক প্রশিক্ষিত গাড়ি চোরচক্র। তাদের মাধ্যমে গাড়ি কেনাবেচা করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। চশমা তারেকের বাড়ি মূলত কিশোরগঞ্জে। একসময় তার পরিবার নবিগঞ্জ উপজেলায় বসতি স্থাপন করে। তার বাবার নাম রহমান আলী। এই তারেকুল ইসলামের একসময় কিছুই ছিল না। গাড়ি চুরির টাকায় এখন তিনি কোটিপতি। গাড়ি চুরির মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলা সদরে চশমার দোকান থাকায় এ নামেই পরিচিতি পান দুর্র্ধষ এই গাড়ি চোর।.
আদালতে নিলামের কারসাজি : যে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে নিলামের কারসাজি করা হয়, সেই একই আদালতের সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর আল আমিনের সঙ্গে কথা বলে রহস্যের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর হাটে হাঁড়ি ভাঙেন গাড়ি চোর চশমা তারেক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ‘নিলাম যথাযথ পদ্ধতি মেনে করা হয়েছে। তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেক অনেক গাড়ি নিলামে নিয়েছেন। এই আদালত থেকে লাখের ওপরে গাড়ি নিলাম করা হয়েছে। ওই সময় আমি দুই মাস মালখানার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের স্টেনো টাইপিস্ট ছিলাম। নিলামকে কেন্দ্র করেই তারেকের সঙ্গে আমার পরিচয়। এর আগে আমি তাকে চিনতামই না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই স্ট্যানো টাইপিস্ট আল আমিন চশমা তারেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে মোটামোটি এখন কোটিপতি।.
এদিকে গাড়ি চোর সিন্ডিকেটের মূল হোতা তারেকুল ইসলাম ওরফে চশমা তারেক ডিবির পদস্থ কর্মকর্তাদের সামনে প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘প্রতি গাড়ি নিলামের জন্য সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর আল আমিন ম্যাজিস্ট্রেটের কথা বলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিতেন। আল আমিন নিজেই নিলামের নথিপত্রে সংশ্লিষ্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নামে স্বাক্ষর করতেন।.
এ তথ্য স্বীকার করে সেখানে উপস্থিত এ সংক্রান্ত মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা যখন তারেককে ধরতে হবিগঞ্জ গেলাম, তখন তারেক নিজেকে রক্ষার জন্য নিলামসংশ্লিষ্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে তিনি সাড়া পাননি। বোঝা যাচ্ছিল, ম্যাজিস্ট্রেট ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। কিন্তু ওই ম্যাজিস্ট্রেট ফোন কেটে দেন। এমনকি গাড়ি নিলামের তথ্য চেয়ে ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে দাপ্তরিক পত্র লেখা হয়। এ সময় সংশ্লিষ্ট আদালতের পক্ষ থেকে ডিবির হাতে জব্দ করা গাড়ি নিলামে দেওয়ার তথ্য অস্বীকার করা হয়। তাহলে কথিত নিলামের মাধ্যমে যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের কী হবে জানতে চাইলে চশমা তারেক বলেন, ‘স্বাক্ষর জাল না আসল, এক্সপার্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হলে বের হয়ে আসবে প্রকৃত চিত্র।’.
পুলিশই প্রত্যক্ষদর্শী : হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থানার সাবেক ওসি মোজাম্মেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘হবিগঞ্জের সাবেক ডিবি ইনস্পেকটর (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলাম ও চশমা তারেক ছিলেন মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। ডিবির অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত যে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার ধরা পড়ত সেগুলোর বিনিময়ে কোনো মামলা দেওয়া হতো না।’.
তিনি বলেন, ‘মাদক চোরাচালানে ব্যবহৃত প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল রেখে দেওয়া হতো। মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কারের বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দেওয়া হতো। শত শত নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ইনস্পেকটর মানিক তারেকের মাধ্যমেই বিক্রি করেছে।’.
এদিকে ইনস্পেকটর মোজাম্মেলের দেওয়া তথ্যের মিল পওয়া যায় পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে দেওয়া ডিবি ইনস্পেকটর (সাময়িক বরখাস্ত) মানিকুল ইসলামের স্ত্রীর অভিযোগেও। তার অপকর্মের দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরে অভিযোগের এক স্থানে বলা হয়, ‘হবিগঞ্জ ডিবির ইনস্পেকটর হিসাবে যোগদানের পর মানিকুল ইসলামের দুর্নীতি ও প্রতারণার মাত্রা বেড়ে যায়। ডিবিতে যোগদানের পর কুখ্যাত চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ী চশমা তারেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তারেককে তিনি চোরাকারবারির পার্টনার বানিয়ে নেন। তারেক বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাই মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কার এনে মানিকের মাধ্যমে অবৈধভাবে ডিবি অফিসের জিডি বইয়ে পরিত্যক্ত হিসাবে উল্লেখ করে নিলামের ব্যবস্থা করতেন। এই টাকার একটা বড় অংশ ইনস্পেকটর মানিক পেতেন। মানিক নিজেও ৫টি চোরাই প্রাইভেট কার এবং একাধিক মোটরসাইকেল নামে-বেনামে নেন। এভাবে কোর্টে পাঠিয়ে সেখানে একটি সিন্ডিকেট করে তারেকের নামে গাড়িগুলো নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হতো। এমনকি তারেক ও মানিক নিজেরাও ব্যবহার করতেন। মানিকুল ইসলামের তৎকালীন ড্রাইভার সুমন হবিগঞ্জ শহরের একজন নামকরা ইয়াবা ব্যবসায়ী। তিনি মানিকের গাড়ির ড্রাইভার হওয়ার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হবিগঞ্জ শহরে প্রকাশ্যে ইয়াবা ব্যবসা করে বেড়ান।.
স্বীকারোক্তিতে চোর সিন্ডিকেট : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উত্তরা পশ্চিম থানায় (ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৫০৭৪) সিলভার কালারের এক্স-করোলা প্রাইভেট কার চুরি সংক্রান্ত গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েন চশমা তারেক। এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০২২ সালের ২ এপ্রিল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি। এ সময় গাড়ি চুরির কথা স্বীকার করে তারেক জবানবন্দিতে জানান, হবিগঞ্জের মাধবপুরের আব্দুল হালিম ও মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের নুরুল হক শহীদ প্রকৃত চোর। তাদের নামে আরও ১৪/১৫টি চুরির মামলা আছে বিভিন্ন স্থানে। হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের উজ্জ্বল ওরফে হৃদয় পাঠান, হবিগঞ্জ সদরে শেখ হাসিনা মেডিকেলের সামনে ফার্মেসির মালিক এএইচ রুবেল ও চশমা তারেক তিনজন পার্টনার। উজ্জ্বল পাঠান আব্দুল হালিম, নুরুল হক ও শহীদের সঙ্গে গাড়ি কেনার কন্টাক্ট করেন। উজ্জ্বল পাঠান বিকাশে ২০ হাজার টাকা পাঠান আব্দুল হালিম, শহীদ ও নুরুল হকের কাছে। পরদিন উজ্জ্বল পাঠান এএইচ রুবেল. ডে-নাইট-নিউজ / উজ্জ্বল আহমেদ হবিগঞ্জ থেকে ফিরে:সারাদেশ বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ
আপনার মতামত লিখুন: