নাম জয়রাম বর্মন। বর্তমান বয়স ১৪ ছুঁইছুঁই। সবে উঠেছে সপ্তম শ্রেণিতে। ছোট্ট দুটি হাত তার। যে হাতে এ সময় থাকার কথা বই-খাতাসহ ব্যাট বল। যে বয়স এখন মাঠেঘাঠে খেলে বেড়ানোর। তার সমবয়সী কিংবা সহপাঠীরা পড়ালেখার ফাঁকে ঠিকই ছুটে যায় খেলার মাঠে। কিন্তু জয়রাম বর্মনের নেশাটা ভিন্ন। হ্যাঁ, সেও পড়া লেখা করে। কিন্তু লেখাপড়ার ফাঁকে তাকে দেখা যায় না খেলার মাঠে কিংবা আড্ডা দিতে। একটু সময় পেলেই যেনো তার সময় কাটে খড়, বাঁশ, মাটি, কাঁদার মাঝে।.
হ্যাঁ সে এই বয়সেই নিপুণ হাতে খড়, বাঁশ, মাটি, কাঁদা দিয়ে তৈরি করছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিমা। দেখে বোঝার উপায় নেই সেগুলো তৈরি ছোট্ট এই শিশুর হাতে। অবাক করার বিষয় হলো এবছর আসন্ন সরস্বতী পূজোতে এ উপজেলার সবচেয়ে বড় প্রতিমার কাজটিও পেয়েছে জয়রাম বর্মন। এছাড়াও সে আরো ১৩টি প্রতিমার কাজ নিয়েছে হাতে। .
কথা বলছিলাম দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের গোকুল গ্রামের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্র্থী ১৪ বছর বয়সী জয়রাম বর্মনের। সে ওই গ্রামের কৃষক জ্যোতিষ বর্মনের ছেলে এবং সুজাপুর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী। সরেজমিনে জয়রাম বর্মনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, খড়, বাঁশ, মাটি, কাঁদা দিয়ে তৈরি করা প্রায় ১৩টি সরস্বতী দেবীর প্রতিমা রৌদ্দে শুখাতে দেয়া আছে। মাটির কাজ প্রায় শেষ। কিছু কিছু প্রতিমায় মাটির প্রলেপ দেয়া বাঁকি সেগুলোই শেষ মুহুর্তে সেড়ে নিচ্ছে ক্ষুদে এই প্রতিমা শিল্পী জয়রাম বর্মন। তাকে মাটি ও কাঁদা মেখে দেয়ার কাজে সহযোগিতা করছেন তারই ঠাকুমা (দাদি) শৌলবালা বর্মন। .
জানা যায়, ছোট থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি তার প্রতিবেশি এক বাড়িতে মাটির প্রতিমা তৈরির কাজ গভীর মনোযোগ সহকারে দেখতো জয়রাম বর্মন। তারপর স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে বাড়ির সামনে থাকা পুকুর পাড়ে মাটি দিয়ে প্রতিমার আকৃতি গড়ার চেষ্টা করতো সে। প্রথমে বাড়ীর লোকজনের বাঁধার সম্মুখিন হলেও ভাঙা গড়ার মাঝে যখন পুরো একটি প্রতিমার আকৃতি দিয়ে ফেলে জয়রাম বর্মন তখন সে বাঁধা কাটিয়ে যায়। এভাবেই হয় এই নিপুণ হাতে প্রতিমা গড়ার জীবনের সূচনা।.
জয়রাম বর্মন বলে, আমি প্রতিবেশি এক কাকার সাথে ৮ বছর বয়স থেকে এ কাজে সহযোগিতা করে আসছিলাম। আমার খুব ভালো লাগতো এগুলো তৈরি করা দেখে। আমি পরে নিজে নিজে বাড়ির সামনের পুকুর থেকে মাটি তুলে প্রতিমা তৈরি করার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। পরে আবারো ওই কাকার কাছে কাজ দেখি এবং তাকে সহযোগিতা করি। এভাবেই একপর্যায়ে প্রতিমা তৈরি করে ফেলি আমি নিজেই। এরপর থেকেই আমি সারাবছর বিভিন্ন প্রতিমার কাজ অর্ডার নিয়ে প্রতিমা তৈরি করছি। প্রতিমা তৈরির অর্থে আমি আমার লেখাপড়া চালানোর পাশাপাশি সংসারের যোগান দিচ্ছি। এবছর আমি ১৩টি সরস্বতি প্রতিমা তৈরির অর্ডার নিয়েছি। ইতোমধ্যে সবগুলোতে মাটির কাজ শেষ। এখন রংতুলির আঁচর দেয়ার পালা। দ্রুত সেগুলো সম্পন্ন করে পূজোর আগের দিন প্রতিমাগুলো ডেলিভেরি দেবো। .
জয়রাম বর্মনের বাবা জ্যোতিষ বর্মন ও মা দিপালী বর্মন বলেন, জয়রাম বর্মনের বয়স যখন ৮বছর তখন থেকেই প্রতিমার গড়ার অনন্য চাহিদা ছিল তার। আমরা প্রথমে তার পাগলামি ভেবে তাকে বাঁধা দেই কিন্তু এক পর্যায়ে ওই ছোট্ট ছেলেটি তৈরি করে ফেলে মনোমুগ্ধকর একটি দেবীর প্রতিমা। যা আমাদেরকেসহ এলাকাবাসীকে অবাক করে। এরপর থেকে তাকে আর এ কাজে বাঁধা দেয়া হয়নি। বর্তমানে সে বিভিন্ন পূজোর সময় প্রতিমা তৈরির অর্ডার নেয়। প্রতিমা তৈরি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোসহ পরিবারে অর্থ যোগান দিচ্ছে সে। আমরা সত্যি গর্ববোধ করি তাকে জন্ম দিয়ে। অনন্য প্রতিভার অধিকারী সে। .
জয়রাম বর্মনের ঠাকুমা (দাদি) শৌলবালা বর্মন বলেন, আমার নাতী জয়রাম বর্মন অনেক ছোট থেকেই এ কাজ করে আসছে। ওর বাবা কৃষক মানুষ। বাড়িতে তেমন একটা সময় দিতে পারে না। আর মা গৃহিনী। সে বাড়ির কাজ কর্ম নিয়েই ব্যস্ত। নাতীর এ প্রতিমা গড়ার কাজে আমি তাকে সহযোগিতা করি। ৮ বছর যখন বয়স ছিল তখন থেকেই সে প্রতিমা গড়ছে। আমি তাকে মাটি মেখে দেয়াসহ খড় বাধার কাজে সহযোগিতা করি।.
প্রতিবেশি তুষার চন্দ্র রায় ও সুকুমার বর্মন বলেন, জয়রাম বর্মনের বয়স এখন লেখাপড়া ও খেলে বেড়ানোর। তার সমবসয়ীরা মাঠেঘাটে খেলাধুলা করলেও জয়রাম একটু ভিন্ন। সে তার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেবদেবির প্রতিমা তৈরি করছে। সেগুলোর চাহিদাও বেশ। তার হাতের তৈরি প্রতিমা উপজেলার বিভিন্ন পূজা ম-প থেকে অর্ডার আসে। সেগুলোতে পূজা-অর্চনা হচ্ছে। জয়রাম বর্মন আমাদের এলাকার গর্ব এতো ছোট বয়সে এতো প্রতিভাবান সে। সে এবছর উপজেলার সব চেয়ে বড় প্রতিমার কাজটি হাতে পেয়েছে। .
দিনাজপুর জেলা শাখা পূজা উদযাপন পরিষদের অন্যতম সদস্য সহকারী অধ্যাপক অমর চাঁদ গুপ্ত অপু ও উপজেলা শাখার সদস্য সচিব ধীমান চন্দ্র সাহা বলেন, শুনেছি জয়রাম বর্মন নামের ১৪ বছর বয়সী এক ছোট্ট প্রতিমা শিল্পী বিভিন্ন পূজোর প্রতিমা তৈরির কাজ করছে। তার তৈরি করা প্রতিমা দিয়ে বিভিন্ন পূজাম-পে পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে। এটি দৃষ্টান্তমূলক। ক্ষুদে এই প্রতিমা শিল্পীর প্রতিভাকে ধরে রাখতে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।.
ডে-নাইট-নিউজ / প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:
আপনার মতামত লিখুন: