বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা বহন করে বহু দীর্ঘশ্বাস এবং বেদনার গল্প, খুব কাছের ব্যক্তিদের জীবিত থেকেও হারানোর গল্প। একটা সময় গিয়ে সবার ইচ্ছে থাকে তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের সাথে সময় কাটানোর, গল্প-গুজব করার। লোক মুখে শোনা : বৃদ্ধরা শিশুদের মত। সন্তানদের শিশু কাল থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করানো কারিগর বাবা-মায়েরা একটা সময় গিয়ে শিশু হয়ে যায়। ছোয়া পেতে চায় আপনজনদের, সংস্পর্শ পেতে চায়, শুশ্রূষা পেতে চায় প্রিয় মানুষদের। বৃদ্ধাশ্রমের বাবা-মায়েরা পুরোপুরি বঞ্চিত। নানা অজুহাতে ছেলেমেয়েরা রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। .
চলতি জুলাই মাসের কোনো এক বৃহস্পতিবারের মিটিংয়ে আলোচনা চলছে। বিষয়: মানবপ্রেমী রক্তদান ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কি করা যায়? মিটিংয়ের মাঝে কেউ একজন বলে ওঠে, চলো সবাই মিলে বৃদ্ধাশ্রম যাই। ব্যাস সে সময়ই ঠিক হয়ে যায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘মানবপ্রেমী রক্তদান ফাউন্ডেশনে’ সময় কাটাবে একটি বৃদ্ধাশ্রমে। পরিবার থেকে ভালোবাসা বঞ্চিত সকলের মাঝে ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়ার আশায় আমরা বেরিয়ে যাই সঠিক বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজে এবং পেয়েও গেলাম মনের মতো। ঢাকার নিকটবর্তী কাপাসিয়া উপজেলায় ‘আব্দুল আলী সেবাশ্রম’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম নির্বাচন করি সবাই মিলে। এরপর সেই বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ দেখে এবং সেখানকার ম্যানেজারের সাথে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। .
সেদিন রাতেই সবাইকে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ঠিক হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (২১ জুলাই) আমরা সেখানে গিয়ে সবার সাথে মধ্যাহ্নভোজ করব, আড্ডা দেবো সারাদিন। এরপর সবাইকে যাবতীয় কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় মধ্যাহ্নভোজে খাবারের মেন্যুতে থাকবে সাদা ভাত, মুরগী, মাছ, সবজি, ডাল, পায়েস, সালাদ, সফট ডিংকস।.
২১ জুলাই, ২০২৩। ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা। বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা ১৪-১৫ জনের। আনুমানিক তিন ঘণ্টা সফরের পর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছায় ‘মানবপ্রেমী রক্তদান ফাউন্ডেশনে‘র সদস্যরা।’ অল্প কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর ১২টার দিকে সবাই ঘুরে দেখেন পুরো বৃদ্ধাশ্রম।.
রাফিজ-রামিম বৃদ্ধাশ্রমের একজন পুরোনো সদস্যের সাথে কথা বলার সময় লক্ষ্যে করে তিনি খুব শুদ্ধ ভাবে ইংরেজিতে কথা বলেছেন। পড়াশোনা কোথায় করেছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, পড়াশোনা শেষ করেছেন দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। কর্মজীবনে চাকরি করেছেন দেশসেরা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। তার বাসা ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। পরিবারে এক ছেলে ও স্ত্রী রয়েছেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কর্মজীবনের এ সফল পুরুষ শাহালাম চৌধুরী (ছদ্মনাম) শেষ জীবনে স্থান হয়েছে কাপাসিয়ার আব্দুল আলী সেবাশ্রমে। এরপর তিনি তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু গল্প শুনিয়েছেন এবং সবসময় বাস্তববাদী হতে উপদেশ দিয়েছেন। .
.
ধীরে ধীরে বিদায়বেলা ঘনিয়ে আসে। বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজারসহ সকলের কাছে থেকে একে একে বিদায় নেয় মানবপ্রেমী রক্তদান ফাউন্ডেশনের সকল সদস্য। .
উল্লেখ্য, আব্দুল আলী সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মো: শাহজাহান সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৬ সনে তিনি চাকুরী থেকে অবসরে যান। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন মানুষের জন্য সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধাশ্রম। বাবা আব্দুল আলীমের নামে নামকরণ করেন আব্দুল আলী সেবাশ্রম। নারী পুরুষ মিলে বর্তমানে ২৯ জন বয়ো:বৃদ্ধ অবস্থান করছেন এ বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁদের বেশিরভাগ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।.
২০১১ থেকে পুরোদমে প্রথমে ৪/৫ জন দু:স্থ মানুষকে সেবাদানের মাধ্যমে তাঁর আশ্রম চালু করেন। প্রতি সপ্তাহে দুদিন একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক “আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম” বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে বৃদ্ধদের চিকিৎসা সেবা দেন। স্থানীয় বহিরাগতদেরও এদিন বিনামুল্যে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়। .
প্রায় ২৬টি ডেস্কটপ কম্পিউটার রয়েছে তার আশ্রমে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত ল্যাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা বিনামুল্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ৬ মাস মেয়াদী সনদও প্রদান করা হয়।. .
ডে-নাইট-নিউজ / রাফিজ হাছান
আপনার মতামত লিখুন: