কংকনা রায় ও কৃপিতা রায়। সম্পর্কে তারা নিজ বোন। তারা তরুণ উদ্যোক্তা। বিপণী প্রতিষ্ঠান ‘কৃপায়িনী’ এর স্বত্তাধিকারী তারা। ফেসবুক প্ল্যাটফর্মেই বিস্তৃতি তাদের এই প্রতিষ্ঠানটি। ফেসবুকে পেজের নাম ‘কৃপায়িনী’।.
কংকনা রায় অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছেন আর কৃপিতা রায় সবে মাত্র ৮ম শ্রেণিতে। কিন্তু তারা এই বয়সেই নিজেদের চেষ্টা আর পরিশ্রমে হয়ে ওঠেছেন উদ্যোক্তা। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজেদের হাতে তৈরি হ্যান্ড পেইন্ট ও ব্লক প্রিন্টের পোশাক যেমন শাড়ি, পাঞ্জাবি, কুর্তি, ফতুয়া, থ্রি-পিস, বিছানার চাঁদর, শাল, টেবিল ক্লোথ অর্ডার নিয়ে বিক্রি করছেন। পাশাপাশি জুয়েলারিসহ কাঠের জুয়েলারি এম্ব্রয়ডারি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে নজর কেড়েছেন সবার। কৃপায়িনী থেকে বিভিন্ন পণ্য পৌঁছে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।.
দিনাজপুরে ফুলবাড়ী উপজেলার পৌরএলাকা সুজাপুর গ্রামে কংকনা রায় ও কৃপিতা রায়ে বাড়ি। সেখানেই তাদের বেড়ে ওঠা। বাবা ব্রজেন্দ্র নাথ রায় পেশায় শিক্ষক আর মা সান্তনা রানী রায় গৃহিনী। কংকনা রায় ফুলবাড়ী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়ণ করছেন। পাশাপাশি তিনি একজন নারী সাংবাদিকও। আর কৃপিতা রায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান ইনস্টিটিউটে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যায়ণ করছেন। .
যেভাবে তাদের যাত্রা শুরু হয়, ছোট বেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে বেশ পটু তারা দুই বোন। ২০২০ সালে লকডাউনে বসে না থেকে সেই দক্ষতাকে ভিত্তি করে মায়ের কাছে ৩ হাজার টাকা নিয়ে কিনেছিলেন শাড়ি, রং আর তুলি। পরিক্ষামূলক শাড়িতে কাজ করেন তারা। কাজটি ভালো হওয়ায় পরবর্তীতে তারা একটি ফেসবুক পেজ খুলে কাজের ছবি পোস্ট করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও উৎসাহ পান। কখনও ভাবেন’নি, মানুষ তাদের কাজ এত পছন্দ করবে। তখন টুকটাক কাজ শুরু করে দেন। অর্ডারও আসতে থাকে। ২০২১ সালের দিকে তারা কাজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেন। নিজেরা কিছু করে আয়ের অর্থ দিয়ে নিজেদের চাহিদা পূরণ করা কথা ভেবেই এই পথে যাত্রা হয় তাদের। পরে ২০২২ সালে সরকারিভাবে ব্লক বাটিকের ওপর তিনমাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন কংকনা রায়। .
জানা যায়, ঈদ-পূজো, বিয়েসহ প্রায় সবসময়ই ব্যস্ততা থাকে কৃপায়িনীর কর্ণধার কংকনা ও কৃপিতার। দিন-রাত কাজ করে গ্রাহকদের চাহিদা মতো পোশাক সরবরাহ করেই তারা। গ্রাহকদের চাহিদার শীর্ষে থাকে শাড়ি আর পাঞ্জাবি। তাদের পুনঃ ক্রেতা অনেক। যারা একবার তাদের কাছে পণ্য নেন, তারা আবারো নেন। এভাবেই তারা গড়ে তুলছেন ক্রেতাগোষ্ঠী। তাদের রয়েছে সব বয়ষসী ক্রেতা। শৌখিন মানুষেরাই বেশি ক্রয় করেন তাদের এই পণ্য। কেউ কেউ আপনজনদের উপহার দেওয়ার জন্যও তাদের থেকে পণ্য ক্রয় করেন। .
কংকনা ও কৃপিতা যে পণ্যগুলো নিয়ে কাজ করেন, সেগুলোর কাঁচামাল তিনি নিজেরাই বাজারে গিয়ে সংগ্রহ করেন। কারণ, কাঁচামাল ভালো না হলে পণ্য টেকসই হবে না। তারা কোনোপ্রকার দুর্বল পণ্য দেন’না ক্রেতাদের। সব নিয়মকানুন মেনেই ব্যবসা করেন। নিজেরা সব পণ্য তৈরি করে পেজের পণ্যগুলো ফটোগ্রাফির জন্য রাখেন প্লাবন শুভকে এবং মডেল হন নিজেরাই। তার যা আয় হয়, তাতেই সন্তুষ্ট তারা। নিজেদের আয়ের টাকা দিয়ে নিজেদের বেশিরভাগ শখ পুরণ করেন এই দুই বোন। এছাড়াও বিভিন্ন অসহায় দুঃখিদেরও সহায়তা করেন তাদের এই অর্থ থেকেই।.
জয়পুরহাট থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে ‘কৃপায়িনী’ থেকে পাঞ্জাবি অর্ডার দেন পাপিয়া পা-ে। তিনি বলেন, ফেসবুকে ‘কৃপায়িনী’ পেজ থেকে পাঞ্জাবি নিয়েছি। সেটি আমি একজনকে উপহার দিয়েছিলাম। আমি উপহারটি যাকে দিয়েছিলাম, সে উপহারটি দেখে অনেক পছন্দ করেছে। সত্যিই কংকনা ও কৃপিতার প্রতিভা অনেক। তাদের কাজ অসম্ভব সুন্দর। আগামীতেও তাদের কাছে শাড়িসহ পাঞ্জাবি অর্ডার করব।’.
আরেক ক্রেতা শিক্ষক পাপিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘কৃপায়িনী একটি আস্থার নাম। যেখানে ইচ্ছে অনুযায়ী হ্যা-পেইন্টের কাজ করিয়ে নেয়া যায়। পছন্দের যেকোনো ডিজাইন করে নিতে কৃপায়িনীর তুলনা হয়না। তাদের কাছে কাজ করিয়েছি। সে কাজের প্রসংশা সবাই করে যখন সেই কাপড়টি পরি। সকলে জিজ্ঞেস করে এটি কোথা থেকে করিয়েছেন। কৃপায়িনী এভাবেই মানুষের আস্তা রেখে এগিয়ে যাক বহুদূর। সাফলতার শীর্ষ উঠুক কৃপায়িনী।’ .
কথা হয় আরো দুই তরুণ ক্রেতা রোহিত সরকার ও অভিজিৎ রায় সৌরভের সাথে। তারাও বলেন, ‘কংকনা আমাদের সহপাঠী। আমরা বেশকিছু পণ্য কৃপায়িনী থেকে নিয়েছি। পণ্যের কাজগুলো সত্যি চমৎকার। আমরা বিভিন্ন উৎসবে তাদের কাছে পাঞ্জাবিতে কাজ করিয়ে নেই।’ তরুণ উদ্যোক্তা কংকনা রায় ও কৃপিতা রায় বলেন, ‘নারীরা সমাজে কিছু করতে হলে, সেক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রয়োজন হয় পরিবারের সমর্থন। যা আমরা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে পেয়েছি। মায়ের দেয়া অর্থ দিয়েই আজ এতোদূর আমরা।.
আমাদের এই কাজের জন্য মানুষ আমাদেরকে আমাদের নিজ পরিচয়ে চেনে-জানে। পড়ালেখার পাশাপাশি শখের বসে কাজ শুরু করে আজ আমরা উদ্যোক্তা হয়েছি। আমাদের কাজ করা পণ্য দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে অর্ডার করা হয়। যা খুবই ভালো লাগে যে মফস্বলে থেকেও আমাদের কর্মের চিহ্ন দেশের বিভিন্নপ্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়ছে। আর যা আয় হয় তা আমরা দুইবোন ভাগ করে নিয়ে নিজেদের শখ নিজেদের আয়ের অর্থেই পূরণ করি।’ .
তারা আরো বলেন, ‘হ্যা-পেইন্টের কাজ করতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সৃজনশীল চিন্তাভাবনা। আমরা মনের মাধুর্যতা মাখিয়ে কাজ করি। এমনভাবে কাজ করি যাতে কোনো গ্রাহক অপছন্দ না করেন, কোনোপ্রকার অভিযোগ না করেন। কিন্তু অনেক মানুষ আছেন যারা, এই কাজ আর পণ্যের কদর জানেন’না। মূল্য দিয়ে এই পণ্যগুলো কিনতে চান না। তাই আমরা যথাযথ মূল্য পাই না। মানুষের বোঝা উচিৎ কাজগুলো কতটা কষ্টের। আমরা আমাদের এ কাজে পরিবারসহ বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতা পেয়েছি।’ .
কংকনা ও কৃপিতার অনুপ্রেরণার দ্যুতি মা সান্তনা রানী রায় বলেন, ‘করোনাকালে মেয়েরা বসে না থেকে আমার কাছে টাকা নিয়ে রং ও শাড়ি কিনে আনে। পরে শাড়িতে রংতুলি দিয়ে এঁকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে। যা দেখে আমিও মুগ্ধ হই। পরে তারা বলে, তারা ফেসবুকে অর্ডার নিয়ে হ্যা-পেইন্টের কাজ শুরু করবে। তাদের প্রতিভা যেনো দমে না যায় সেজন্য আমি তাদেরকে পুরো সমর্থন দেই। আজ তারা এ কাজ করে বিভিন্নস্তরে পরিচিতি লাভ করছে নিজেদের। আর কাজ থেকে আয়ের অর্থ দিয়ে তারা নিজেদের শখ পূরণ করছে। মেয়েদেরকে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। তবেই তারা সমাজসহ পরিবারে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’.
ফুলবাড়ী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রীতা ম-ল বলেন, ‘কংকনা রায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ব্লকবাটির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সে খুবই কর্মঠ ও মেধাবী। তারমধ্যে মহুমাত্রিক গুণাবলি রয়েছে।’ .
ডে-নাইট-নিউজ / প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:
আপনার মতামত লিখুন: