আমার দেখা ৭১
মিজানুর রহমান মিজান
অনেক সংগ্রাম , ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে আমরা বৃটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে পাকিস্তান নামক দেশটি অর্জিত হলেও কাংখিত, ,প্রকৃত স্বাধীনতার পথে পাকিস্তানীরা বাঁধ সাঁেধ প্রারম্ভিকেই। শুরু করে ষড়যন্ত্র বাঙ্গালীকে দমিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে। প্রতারণা ও টাল-বাহানা শুরু করে মাতৃভাষা বাংলাকে কেড়ে নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা রুপে প্রতিষ্টা করতে। এ দেশের বুদ্ধিজীবি , ছাত্র সমাজ তা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী তুমুল আন্দোলন , আত্ম-ত্যাগের বিনিময়ে রাজ পথ রঞ্জিত করে মায়ের ভাষা , প্রাণের ভাষা রক্ষার রক্তাত্ত ইতিহাস রচনা করেন। শুরু স্বাধীকার আন্দোলনের লড়াই। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন সৌধ স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনে ভীত হয়ে পাকিস্তানীরা বাধ্য হয় সাধারণ নির্বাচন দিতে। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অভূত পূর্ব একক সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন হলে ও পাকিস্তানী শাসক চক্র বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা প্রকার দুরভিসন্ধি , ফন্দি আটঁতে থাকে। পাকিস্তানী শাসক চক্রের বিবিধ মিথ্যাচার অনুধাবনে শেখ মুজিব ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন,” এবারের সংগ্রাম .........স্বাধীনতার সংগ্রাম”। বাঙ্গালী জাতি ফুসে উঠে , উজ্জীবিত তেজোদ্দীপ্ত প্রেরণায় অসহযোগ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। দিশেহারা শাসক চক্র একটি সেনাবাহিনী আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর লেলিয়ে দিয়ে রাতের আঁধারে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে নির্বিচারে চালায় গুলি। অসংখ্য মানুষ হত্যা করে বাংলাকে নিশ্চিন্ন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল। এ দেশের কৃষক ,শ্রমিক , ছাত্র জনতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জীবন বাজি রেখে মরণ পণ লড়াইয়ে হয় অবতীর্ণ।
১৯৭১ সাল। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ’৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিভিন্ন মিটিং মিছিলে জন সাধারণের মুখে ছিল আওয়ামী লীগের স্বপক্ষে ভোট দানের কথা। আমাদের এলাকায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মিছিল বের করলেই মনের আনন্দে সেখানে অংশ নিতাম এবং কণ্ঠে ছিল ”জয় বাংলা” শ্লোগান। জয় বাংলা শ্লোগান দিলে বা শুনলে এক প্রকার শিহরণ অনুভুত হত। মানুষের মুখে মুখে উচচারিত হত আরেকটি বাক্য “ আইয়ুবের শাসন , শেখ মুজিবের ভাষণ”। শেখ মুজিবের ভাষণে ছিল এক প্রকার যাদুময়তা। ভাষণে মানুষ অনুভুত শিহরণে উদ্বেলিত অনুপ্রেরণায় সিক্ত হয়ে মুখরিত অপরিসীম ভালবাসায় যেত এগিয়ে। আমি সমবয়সীদের নিয়ে রঙ্গীন কাগজ কেটে বাঁশের শলাকায় লাগিয়ে মিছিল দিতাম জয় বাংলা বলে। অনুরুপ প্রতিটি গ্রামে চলত এভাবে ছোটদের রঙ্গিন কাগজের তৈরী নিশান নিয়ে মিছিল। তাছাড়া সে সময় মিছিল হলেই দেখা যেত বাঁশের শলাকা দিয়ে তৈরী নৌকায় রঙ্গিন কাগজ মোড়ে বাশেঁর খুটির অগ্রভাগে বেঁধে উচু করে দিতেন মিছিল। স্থানে স্থানে গাছের ডালে বেঁধে রাখা হত নৌকার প্রতীক।
২৫ শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হবার পর ( পাঠক ক্ষমা করবেন তারিখটি স্মরণ নেই) রাজা গঞ্জ বাজার এলাকা এবং তদপশ্চিম এলাকা থেকে এক দিন বিরাট মিছিল আসে লাঠি সোটা হাতে নিয়ে সিলেট অভিমুখে যাত্রার উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য পাকিস্তানী বাহিনীর সহিত যোদ্ধ করা। মিছিল যতই অগ্রসর হতে থাকে ততই চর্তুদিক থেকে লোক জড়ো হতে থাকে। অর্থ্যাৎ মিছিলে লোকে লোকারন্য। মিছিল ছুটে চলে পূর্ব দিকে। দৌড়ে আমি ও অংশ নেই। কিন্তু আমাদের বয়সীদেরকে বড়রা সকলেই বাড়ি চলে যাবার তাগিদ দিচিছলেন। খাজাঞ্চি রেল ষ্টেশন পর্যন্ত গিয়ে আর অগ্রসর হইনি। এক দিকে বড়দের নিষেধাজ্ঞা ও ক্লান্তি আসায়। তাছাড়া আরো সুবিধা ছিল পাশেই মামার বাড়ি থাকায়। কি দারুণ দেশপ্রেম মানুষের মনে। স্বাধীনতার জন্য একটি সুসজ্জিত আধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষিত বাহিনীর সহিত যুদ্ধের নিমিত্তে জনসাধারণের এগিয়ে চলা। নেই ভয়, সংকোচ। নির্ভিক অসীম সাহসে বলিয়ান। নদীর স্রোতে যেমন কচুরিপানা ভেসে চলে ভাটির দিকে , অনুরুপ বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত মানুষের স্রোত পূর্ব দিকে ধাবমান। কামাল বাজার পর্যন্ত মিছিলটি যায় এগিয়ে নির্বিকার চিত্তে। কিন্তু বেলা অনুমান দুই তিনটার দিকে দেখা যায় ছত্র ভঙ্গের মত মানুষের ফিরে আসার দৃশ্য। কাউকে জিজ্ঞাসায়, আবার বড়দের কথোপকথন থেকে সেদিন জানতে পারি কামাল বাজার মিছিলটি যাবার পর সিলেট শহর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেহ কেহ ছুটে এসে জনতাকে শান্তনা ও পাকিস্তানী বাহিনীর হিংস্রতা সম্পর্কে , আধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষিত বাহিনীর সহিত এ ভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই বিকল্প হিসাবে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এ সময় লক্ষ্য করা গেছে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চারিত। উদ্ধেগ, উৎকণ্ঠা অপরিসীম। যে প্রাণে কিছুক্ষণ আগে ও ছিল সাহস। নিমেষেই তা যেন উধাও। সেদিন থেকে শুধু মাত্র রাজা গঞ্জ বাজারেই মিছিল দিতেন হাট বারে। মাত্র ক’দিন। ( পাঠক ক্ষমা করবেন বয়সের অনুপাতে দুরবর্তী কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না বিধায় নিকবর্তী দেখা কথা এখানে বলছি) যতই দিন যায়, যুদ্ধের ভয়াবহতা শুনে তা থেকে সকল পিছু হটেন এবং শুরু হয় ফিসফিস করে কথা বলা কি ভাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা যায়। অত:পর শুনতাম অমুক চলে গেছেন ভারতে মুক্তি বাহিনীতে যোগদানের নিমিত্তে।
আমাদের এলাকাটি তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে। বিশ্বনাথ যেতে হত পায়ে হেঁটে। ছিল না বিদ্যুত। আমরা ভাবতাম বিদ্যুত শহরের জন্যই প্রযোজ্য। তা গ্রামের জন্য প্রযোজ্য নয়। কোন পত্রিকা পাওয়া যেত না। খবর শুনার এক মাত্র ব্যবস্তা ছিল তখন রেড়িও। তা রেড়িও ও খুব কম সংখ্যক লোকের ছিল। যা হাতে গুণা। গ্রামে দু’একজনের। কান্দিগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শ্রদ্ধেয় নুরুল আমিন নামক একজন শিক্ষক আমাদের বাড়িতে থাকতেন লজিং এ। তিনি বহুদিন ছিলেন আমাদের বাড়িতে। তিনির বাড়ি ছিল নোয়াখালী জেলায়। বেশ কিছুদিন বাড়িতে যেতে পারেননি। আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহোদয়কে দেখতাম বিমর্ষ। বড়রা তিনিকে শান্তনা দিতেন। অনেক দিন পর একদিন সুযোগ বুঝে তিনি বাড়িতে যান। পরে পত্র দিয়ে আমাদেরকে জানান তিনির ভাল ভাবে বাড়িতে পৌছার সংবাদ। তাছাড়া ও আমাদের বাড়িতে বেশ ক’দিন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৫ জন কর্মকর্তা ছিলেন। তারা ও সুবিধাজনক সময়ে চলে যান। আমি দেখেছি খাজাঞ্চী রেলষ্টেশন হয়ে এসে রাজা গঞ্জ বাজার দিয়ে অনেক নারী পুরুষ বিক্ষিপ্ত , বিচিছন্ন ও উ™£ান্তের মত অজানা গন্তব্যের পথে যেতে। এ কারনে দেখার সৌভাগ্য হয়ত হয়েছিল, যেহেতু তখন খাজাঞ্চী রেলষ্টেশন থেকে রাজা গঞ্জ বাজার হয়ে রসুল গঞ্জ পর্যন্ত লোক চলাচলের এক মাত্র রাস্তা ও অবলম্বন ছিল ঐ একটি রাস্তা। তখন উহার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
আমাদের নিকটবর্তী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ ¯া’ন শিতলী বাড়ি (পুনি, বান্নি)। প্রতি বৎসর চৈত্র মাসের প্রতি শনি মঙ্গল বারে এখানে বসে মেলা। প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। এক দিন শনিবার। গিয়েছি মেলায়। বেলা এগারটার দিকে হঠাৎ করে দেখা যায় ফাইটার বিমান এসে চক্কর শুরু করেছে মেলার উপর দিয়ে। বিমান দেখে মানুষের সে কি দৌড়াদৌড়ি। যে যেদিকে পারে ছুটে চলে। বড়রা বলতে থাকেন লোক জমায়েত দেখে বিমানের চক্কর দেয়া। আমি প্রাণ ভয়ে সঙ্গি সাথিদের ফেলে দৌড়ে দিশেহারার মত পাশের বোরো ক্ষেতের মধ্য দিয়ে কাঁদা পানি ভেঙ্গে দৌড়াতে থাকি অপরাপর অনেকের সাথে। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে একটু দৌড়েই হাপিয়ে উঠি। চেয়ে দেখি পরিচিত কাউকে পাচিছ না। বোরো ক্ষেতের আইলে বসে অনেকের মত আমি ও বিশ্রাম নেই অনেকক্ষণ। তারপর ঐ দিক পরিহার করে অনেক জায়গা ঘুরে আসি বাড়িতে। এ বৎসর আর মেলা বসে নাই। রাজা গঞ্জ বাজার অনেক দিন সন্ধ্যার পূর্বেই জন শুন্য হয়ে যেত। বাজারের প্রতিটি দোকানে থাকত মশালের আলো। রাত্রে মশালের আলো দেখে ফাইটার আসার ভয়ে এ ব্যবস্তা নিতেন সকলেই।
সঠিক তারিখ মনে নেই একদিন পাঞ্জাবীদের ডাকে সকল মুরবিবয়ানরা সমবেত হন। সবার ধারণা ছিল যুবকদেরকে নিয়ে গেলে ওরা মেরে ফেলবে। এ জাতীয় ঘটনা অনেক স্থানে হয়েছে ও । এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরবিবয়ানদের সমবেত করে ছাতক-সিলেট রেল লাইনের মাকুন্দা নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল তরুণরা কোথায় ? আমতা আমতা করে মুরবিবয়ানরা বিভিন্ন জবাব দিয়েছিলেন। ওরা সন্তুষ্ট হতে না পেরে সে দিন সকলকে সাঁতার কেটে ভরা নদী পার হবার নির্দেশ দিয়েছিল। অনেকে প্রাণ ভয়ে সাঁতার কাটতে রাজি ছিলেন। আবার কেহ অল্প দুরে গিয়ে মরার উপক্রম হওয়াতে এনে কাউকে কাউকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে , অনেকক্ষণ দাঁড় করে শাস্তি নিশ্চিত করেছিল। অত:পর নির্দেশ ছিল প্রতি রাত্রে ঐ ব্রীজ পাহারা দেবার পালাক্রমে প্রতি গ্রাম থেকে দু’জন করে। আমার বাবা যেতে অক্ষম থাকায় অপর লোক তথা মজুর শ্রেণীর মানুষ দিয়ে টাকার বিনিময়ে তা পুষিয়ে নিতেন। অনুরুপ অনেকে মজুর দিয়ে তা রক্ষা করতেন সমুহ বিপদের ভয়ে। এক সময় নির্দেশ হল পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমুহের প্রত্যেক পরিবার থেকে আস্ত বাঁশ দেবার। মানুষ ভয়ে বাঁশ দিয়েছিল। আমার মামার বাড়ি যাবার ঐ একটি মাত্র রাস্তা থাকায় যাওয়া-আসার বেলা দেখেছি আস্ত বাঁশ খুটি রুপে স্থাপন করে নদী বেড়াঁ দেয়া। শুধু মাত্র নৌকা চলাচলের রাস্তা এবং রেল গাড়ি যাবার রাস্তা রেখে। ব্রীজের উভয় পার্শ্বে ছিল ব্যাংকার এবং টং গৃহ যেখানে বসে রাজাকাররা পাহারা দিত। তৎকালীন সময় সেখানে খেয়া নৌকা ছিল মানুষ পারাপারের নিমিত্তে। মানুষ খেয়া নৌকায়ই পারাপার হতেন। ব্রীজের উপর দিয়ে যেতে দেয়া হত না। একদিন সন্ধ্যার পর পরই পাঞ্জাবী সেনারা এসে ধরে নিয়ে যায় বেশ কিছু লোককে। তাদের মধ্য থেকে গমরা গোল নিবাসী মজম্মিল আলী , ঘাসি গাঁও নিবাসী ছমরু মিয়া ( স্বাধীনতা উত্তর নির্বাচিত খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ভাইস চেয়ার ম্যান) , নুর পুর নিবাসী পল্লী চিকিৎসক ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল করিম , পাহাড় পুর নিবাসী লিলু মিয়া ও সিলেট শহরের বাসিন্দা যিনি যুদ্ধের ভয়ে লালার গাঁও এসেছিলেন প্রাণ রক্ষার্থে রন দাসকে দীর্ঘ দিন বন্দি করে রাখে। স্বাধীনতা তথা বিজয় অর্জনের কিছুদিন পূর্বে মুক্তি দিয়েছিল পাক বাহিনী। এ ব্যাপারে আমি পৃথক একটি লেখা লিখেছি। তারপর একদিন পাক সেনারা আসে খাজাঞ্চী রেল ষ্টেশনে। এখানে এসে হোসেন পুর নিবাসী কটু মিয়ার ছেলে ছোয়াব আলীকে হাল চাষের কাজ থেকে ধরে নিয়ে রেলষ্টেশন সংলগ্ন টিউবওয়েলের কাছে গুলি করে মেরে ফেলে এবং ঐদিনই খলিল উল্লা পিতা মৃত রসিদ আলী গ্রাম হোসেন পুর নিবাসীকে ধরে আনয়ন করে এবং খলিল উল্লা মসজিদের নিকট এসে প্রশ্রাব করার কথা জানালে সুযোগ দেয় প্রশ্রাব করার। কিন্তু প্রশ্রাবে বসলে মসজিদের প্রশ্রাব খানায় বসা অবস্তায় গুলি করে মেরে ফেলে।এ দুই শহিদকে গ্রামবাসী সম্মিলিত ভাবে হোসেন পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কবরস্থ করেন।
তাই শুনে মানুষ আরো অধিকতর ভয় পেয়ে যায়। সুতরাং পাক বাহিনীর কথা শুনলেই মানুষ আতংকিত হয়ে যেত। কোথাও যেতে বা পাক বাহিনীকে দেখা দিতে তরুণ সম্প্রদায় ছিলেন অত্যধিক ভীত সন্ত্রস্ত। এরই মধ্যে শুনা যায় সিরামিশি গ্রামে শতাধিক ব্যক্তিকে গুলি চালিয়ে হত্যার কথা। এক দিন কামাল বাজার এলাকায় পাক বাহিনীর কবলে পড়েন এক ব্যক্তি। তিনির হাতে ছিল রুমালে বাঁধা পরণের একটি পাঞ্জাবী। পাক সেনারা জিজ্ঞাস করে এতে কি ? তিনি উত্তর দেন পাঞ্জাবী বলে। উপহাস করছেন মনে করে মারতে উদ্যত হলে ও ঐ রাস্তায় পথিক রুপে ছিলেন জয়নগর নিবাসী সময়ের শ্রেষ্ট আলিম প্রয়াত জনাব ইজ্জত উল্লা (র:)সাহেব। তিনি বিষয়টি পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়াতে তখন ঐ ব্যক্তি রক্ষা পান।
অবশেষে রেলওয়ে ব্রীজ এলাকায় রাজাকার পাক বাহিনী কর্তৃক নিয়োজিত হলে এক জন রাজাকার ছিল অধিক লম্বা এবং হিংস্র প্রকৃতির। তাকে সকল মানুষ ভয় পেত অধিক। রাজা গঞ্জ বাজার প্রতি হাটবারে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আগমণ করে সকলেই উত্তর দিকে খেয়াল রাখতেন রাজাকাররা আসছে কি না এবং যত দ্রুত সম্ভব হাট বাজার করে চলে যেতেন। অনেককে বাড়ি গিয়ে বলে আসত মোরগ প্রদান করতে। না দিলে অত্যাচারের ভয়ে দিয়ে পাঠাতেন। তবে আমাদের এলাকায় ঘর বাড়ি পোড়ানো হয়েছে বলে শুনিনি। আমার ধারণা অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্তাই আমাদেরকে অনেকটা সুরক্ষিত রাখে। মাকুন্দা নদী অথৈ জলে ভরপুর। একদিন বেলা অনুমান ১১/১২ টা হবে লঞ্চ যোগে আসেন শহিদ আলী এডভোকেট। সঙ্গে ছিলেন আরো মানুষ। রাজা গঞ্জ বাজারে মাইক বাজিয়ে অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়। হাতে গুণা ক’জন মুরবিবয়ান ছিলেন উপস্থিত। অনেকে অতি সন্তর্পনে আড়ালে থেকে শুনার চেষ্টা করেছেন। ছোট হলে ও লুকিয়ে সেদিন শুনেছিলাম , দেখেছিলাম বয়স্ক একজন ক্ষীনকায় ব্যক্তি গান পরিবেশন করতে। ভরাট গলায় গেয়েছিলেন ” পাকিস্তানী ভাইও রে , ভুল করোনি চাইও রে , দফার কোম্পানী আইরা ভোটের বাজারে ”। এ সময় আরেকটি নির্বাচন হবার কথা অনুষ্টানে আগত ব্যক্তিরা বক্তৃতায় আভাষ দিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু আর নির্বাচন হয়নি।
বাজারের পার্শ্ববর্তী বিলপার গ্রামের অধিবাসী প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক একটি গান গাইতেন প্রায় সময় যা শুনেছি , তাহলো Ñ ” মিলিটারি আইলো দেশে রে , দেখতে লাগে ডর , হাতে গল্লা কাঁেধ রাইফেল ,যেমন আজাগর রে”। গানটির রচয়িতা তিনি নাকি অন্য কেউ তা জানতে পারিনি।
যুদ্ধের খবরাখবর শুনার জন্য মানুষ জড়ো হতেন অতি সন্তর্পনে। বড়রা কয়েকজন মিলে শুনতেন এবং ছোটদের বলতেন খেয়াল রেখ পাঞ্জাবী আসে কি না। আবার কখন কখন কান লাগিয়ে রেড়িওর সংবাদ শুনতেন আকাশ বানী, কলকাতা ইত্যাদি রেড়িও ষ্টেশনের। ডিসেম্বর মাসের প্রথম অথবা নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এক দিন বেলা ২ টার সময় আমি কান্দি গ্রাম স্কুল ছুটির পর বাড়িতে যাচিছ বই পত্র বগলে পুরে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের রাজা গঞ্জ বাজারের রাস্তা ধরে। বাড়ির একটু পূর্বে পৌছার পর সম্মুখে চেয়ে দেখি বেশ কিছু পাকিস্তানী সৈন্য সারি বদ্ধ ভাবে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে আসছে। অর্থ্যাৎ আমার দিকে। আমি দেখেই ভয়ে মোর্ছা যাবার উপক্রম। নিকটে এসে সম্মুখের সৈন্যটি আমাকে জিজ্ঞাস করে এ এলাকায় হিন্দু বাড়িঘর আছে কিনা ? জানি না, যেন অলৌকিক ভাবে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল তৎক্ষণাৎ নেই। যদি ও ২০০/৩০০ গজের মত দুরত্বে দক্ষিণ দিকের মোহাম্মদ পুর গ্রামটির অবস্তান এবং পুরো গ্রামটি হিন্দু বসতি গ্রাম। এ কথা বলার পর ভয়ে আমার অন্তরাত্বা কাঁপছে ঠক ঠকিয়ে এখন যদি জানতে পারে নিকটেই হিন্দু বসতি গ্রাম। তবে মিথ্যা বলার খেসারত হয়ত আমাকে করবে গুলি। তাই ভেবে আমি এক প্রকার দৌড়ে আড়াল হই ও বাড়িতে যেয়ে বয়স্কদের বলি। বড়রা ঝুপ ঝাড়ের আড়ালে থেকে তাদের এগিয়ে চলা প্রত্যক্ষ করেন। ঐ দিন ওরা রাজা গঞ্জ বাজারÑঘাসি গাঁও হয়ে খাজাঞ্চী রেল ষ্টেশন দিয়ে রেলযোগে সিলেট গমন করে। পরে শুনেছি বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে ঘাসি গাঁও গ্রামের দক্ষিণ দিকের ক্ষেতে এক ব্যক্তি বাশেঁর শলাকা দ্বারা মানুষ আকৃতির কাকতাডুয়া রেখেছেন। তা দেখে ওরা পজিশন নিয়েছিল মুক্তি বাহিনী মনে করে। এখানকার একজনকে পেয়ে কাকতাডুয়া জানতে পেরে চলে যায়। আমাকে অবশ্যই বাংলায় প্রশ্ন করেছিল। আমি পরে অনুমান করলাম পাকিস্তানী সৈন্যরা আগে পিছে বাঙ্গালী রাজাকারদের রাখত , বিপদ হলে বাঙ্গালীই যাতে সর্বাগ্রে আক্রান্ত হয়। ক্ষমা করবেন তারিখ স্মরণ নেই একদিন মধ্য রাত্রি বেলা ঘুম থেকে ভয়ে উঠি হকচকিয়ে এবং ভয়ানক ভীত হয়ে কানফাটা আওয়াজ শুনে। এত ভয় এ পর্যন্ত আমি কখন ও পাইনি। কারন ভূ-কম্পনের মত মাটি কাঁপছিল। পর দিন সকালে জানতে পারি মাকুন্দা নদীর উপর রেলওয়ের নির্মিত ব্রীজটি বোমা মেরে পশ্চিমের পিলারটি উড়ানো হয়েছে এবং এ স্থানে বিরাট বড় ও গভীর গর্ত হয়েছে। বেশ ক’দিন পর গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছি। ব্রীজের নিকটে অবস্তান করছে অত্র এলাকার ১৯৭২ সালে স্থাাপিত উত্তর বিশ্বনাথ হাই স্কুলটি। যেখানে আমি লেখাপড়া করেছি এবং পঠিত স্কুলে আমার চাকুরি জীবন শুরূ শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে ১৯৮০ সালের দিকে। ছিলাম দীর্ঘদিন ঐ স্কুলের পরিচালনা কমিটির আমি একজন শিক্ষানুরাগী সদস্য। স্কুলের ছাত্র হবার সুবাদে স্বাধীনতা উত্তর ব্রীজ মেরামত প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল নিকটে থেকে।
স্বাধীন হবার ৮/১০ দিন পূর্বে আমার এক সহপাঠি হঠাৎ বলেন বেলা ২/৩ টার সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন। আমাদের গ্রামের পশ্চিম দিকে এসে ভুলা গঞ্জ গ্রামে গিয়েছেন। মুক্তি যোদ্ধা দেখার জন্য দৌড়ে যাই সমবয়সী কয়েকজন বড়দের অনুসরণ করে। কিন্তু মুক্তি যোদ্ধারা আমাদের কাছে ঘেঁষতে দেননি। তাঁরা বলছিলেন এখনই আমরা গোলাগুলি আরম্ভ করব। সুতরাং সরে যাবার তাগাদা দিচিছলেন। মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত কাজ করছিলেন যুদ্ধের প্রস্তুতির নিমিত্তে। ঘন্টা খানেক পর সত্যিই সেদিন গোলাগুলি আরম্ভ হয়ে যায়। তবে রাত প্রায় ন’টার দিকে আর শব্দ শুনা যায়নি। নতুবা দীর্ঘস্থায়ী হলে হয়ত আমরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যেতে হত। কারন পর দিন জানতে পারি ভুলা গঞ্জ গ্রামের প্রয়াত সাবেক মেম্বার মন্তাজ আলীর স্ত্রী পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থেকে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
এ ঘটনার অতি অল্প দিন পর আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সেদিন মানুষের মনে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তা শুধু অনুভব ও অনুভুতির ব্যাপার। মাকুন্দা নদীর উপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রীজ পাহারায়রত রাজাকাররা পালাতে থাকে। একজন রাজাকারকে ধরে জনতা উল্লাস করেন এবং অনেকে থু থু দিচিছলেন। অত:পর মুক্তি যোদ্ধারা নিয়ে যান ঐ রাজাকারকে থানায় অর্পন করার নিমিত্তে।
পরিশেষে বলতে চাই দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত , অগণিত মা বোনের সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা , পৃথক একটি পতাকা বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে সাফল্য ও সফলতায় এগিয়ে যেতে পারি দেশপ্রেম নিয়ে উদ্বুদ্ধ অর্জনে এ প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ঐকান্তিক। তাহলে দেশপ্রেমিক শহিদদের আত্মা শান্তি পাবে। তাঁদের চেতনা হোক পূর্ণ বিকশিত আমাদের কথায়, কাজে, আচার-আচরনে। ১৬ ই ডিসেম্বর আমাদের অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জনের দিন। এ বিজয়কে আনন্দ বেদনার সম্মিলিত প্রয়াসে উজ্জিবিত রাখার দায়িত্ব আপনার আমার সকলের। সচেতন নাগরিক হিসাবে ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচচার ও সচকিত হবার আহবান প্রতিটি নাগরিকের প্রতি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক সম্মুখ পানে সত্যিকার অর্থে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রুপে। এ মোর প্রাণের আকুতি।
লেখক মিজানুর রহমান মিজান , সম্পাদক দীপ্তি , ডাক রাজা গঞ্জ বাজার ৩১৩০ , বিশ্বনাথ , সিলেট। .
ডে-নাইট-নিউজ / মিজানুর রহমান মিজান
আপনার মতামত লিখুন: