শুধু ২৬ শে আগস্ট আসলে মনে পড়ে
চিরপঙ্গুত্ববরণকারী বাবলু রায়ের কথা!
পূর্বে সকলে খোঁজখবর রাখলেও এখন কেউ খোঁজ রাখেন না তার.
আজ ২৬ শে আগস্ট। আজকের এইদিনটা দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর বাবুল রায়ের (৪৯) জীবন খাতায় নরকীয় একটি দিন। ২০০৬ সালে আজকের এইদিনে ফুলবাড়ী রক্ষার্থে কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশ ও তৎকালিন বিডিআরের ছোঁড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বরণ করতে হয় চিরপঙ্গুত্ব। থেমে যায় জীবনের রঙিন অধ্যায়। পূর্বে বহু বন্ধু-বান্ধব থাকলেও, এখন শুধু বিছানা-বালিশ আর হুইলচেয়ারই তার আপন বন্ধু।
.
তিনি ফুলবাড়ী উপজেলার পৌরএলাকার সুজাপুর কামারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি ছিলেন রিকশাভ্যান চালক। বিবাহিত জীবনে তিনি তিন পুত্র সন্তানের বাবা। ওই দুর্ঘটনার পর বাবলু রায়ের শরীরের অর্ধেক অংশ অচল হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলেন কর্মক্ষমতা। এখন তার ছেলেই বইছে পরিবারের হাল।
সরেজমিনে বাবলু রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় চৌকিতে (খাট) শুয়ে আছেন বাবলু রায়। শুয়ে-বসে থাকায় শরীরে ধরেছে পচন (চর্মরোগ)। ডাক্তারের কাছে চিকিৎসাও করিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন এই রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। তাই চিকিৎসা বন্ধ করলেই ওই রোগ আবারো দৃশ্যমান হবে। তাই তার স্ত্রী ও মা সবসময় তার শরীর জীবানুনাশক ওষুধ দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছেন। তিনি পারিবারিক জীবনে এখন সুখী আছেন বলে জানিয়েছেন।
২০০৬ সালের ২৬ আগস্টের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বাবলু রায় বলেন, ‘প্রতিদিনের ন্যায় সেদিন আর রিকশা-ভ্যান বের করিনি। সকালে বাড়ী থেকে খাবার খেয়ে তেল-গ্যাস জাতীয় কমিটির ডাক দেওয়া এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে বের হই। তখন আমার স্ত্রী ৬ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। ফুলবাড়ীস্থ ঢাকা মোড় থেকে খনি বিরোধী মিছিল বের হলে আমি তাতে অংশ নেই। মিছিলটি ছোট যমুনা নদীর সেতু পার হয়ে পশ্চিম পাশে যেতেই পুলিশ-বিডিআর ব্যাপক লাঠিচার্জসহ গুলিবর্ষণ করে। লোকজন দিকবেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। হটাৎ একটি গুলি আমার পিঠে এসে লাগে। আমি লুটিয়ে পড়ি । এরপর আর কিছু বলতে না পারলেও পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বেডে নিজেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই। পরে রংপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, ক্রমা সেন্টার ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দীর্ঘ ১১মাস চিকিৎসা শেষে হুইলচেয়ারে বাড়ী ফিরে আসি।
বাবলু রায় আরও জানান, বর্তমানে তিনি দীর্ঘ তিন মাস ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কোমরে ঘা হয়েছে। প্রতিদিন মা ও স্ত্রী সেই ঘা গুলো ধুয়ে দেন। এরই মধ্যে চলতি বছরের গত ১৪ জুন তারিখে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন তিনি। বর্তমানে করোনা মুক্ত হলেও কোমরের ব্যাথা কমছে না। আগে হুইল চেয়ারে ভর করে অন্তত বাড়ীর বাইরে বের হতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে একবারেই শয্যাশায়ী হয়ে গেছেন। বিছানাই এখন তার নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে। নিজে আয়-রোজগার করতে না পারায় তার দুইছেলে রাজমিস্ত্রি জোগারীর কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে অনেক কষ্টের মধ্যে পরিবার চলছে। তেল গ্যাস জাতীয় কমিটির নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্যার খোঁজখবর নেন এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। প্রতিবারে ২৬ আগস্টে হুইল চেয়ারে ভর করে মিছিলে যোগ দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। কিন্তু এবার তিনি সেটুকুও পারবেন না। কারণ শরীর একেবারেই চলছে না। তবে বিছানা থেকেই শ্রদ্ধা জানাবেন শহীদদেরকে। ফুলবাড়ী কয়লাখনি থেকে এক টুকরো কয়লা যেন কোন বহুজাতিক কোম্পানী নিতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহবান জানান এই পঙ্গুত্ববরণকারী বাবলু রায়।
.
.
ডে-নাইট-নিউজ / প্লাবন শুভ, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি:
আপনার মতামত লিখুন: