সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা প্রবাসী অধ্যুষিত অনেক জ্ঞানী গুণীদের জন্মস্থান হিসাবে দেশে বিদেশে পরিচিত একটি জনপদ।ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক হিসাবে পরিগণিত।আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ উপজেলার ভৌগলিক অবস্থান।তম্মধ্যে ২নং খাজাঞ্চী ইউনিয়ন ৮৩টি গ্রাম নিয়ে বিশ্বনাথ উপজেলার উত্তর সীমান্তে অবস্থিত।যে কারনে উত্তর বিশ্বনাথ নামের সহিত সংযুক্তি রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।খাজাঞ্চী ইউনিয়নের পৃথক একটি সুখ্যাতি হচ্ছে কৌডিয়া পরগণার অন্তর্ভুক্তিতে কৌডিয়া নামের বিশেষ বিশেষণে ভুষিত।অথচ খাজাঞ্চী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন স্থানে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নাম নিয়ে অবস্থান করছে।খাজাঞ্চী নামকরণের ইতিহাস আমি অন্য লেখায় বিবৃত করেছি। আজ এ লেখায় ইসলামাবাদ পোস্ট অফিসের নামকরণ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনার আশা রাখি। যদিও নামকরণ নিয়ে এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।তবে অনেক সময় প্রাসঙ্গিকতায় অনেক কিছু এসে যায়।খাজাঞ্চী ইউনিয়নের এক সময়ের চেয়ারম্যান ছিলেন মরহুম আব্দুল মজিদ।তিনির বাড়ি হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের অনতি দুরে ইসলামাবাদ গ্রামে। সে সময় পোস্ট অফিস স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় পরিষদ সংলগ্ন স্থানে।তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঐ সময় নিজের অর্থায়নে ভুমি ক্রয় করে পোস্ট অফিস স্থাপনের উদ্যোগ ও বাস্তবায়িত হলে তিনি নামকরণের ক্ষেত্রে নিজ গ্রামের নামে তা প্রতিষ্ঠা করেন।এখানে ইসলামাবাদ ও ইসলাম পুর গ্রাম নিয়ে অন্য লেখায় বিস্তারিত আলোচনার আশা রাখি।যাক আমরা প্রাসঙ্গিকতায় অনেক দুর এসে গেছি। পাঠকের ধৈযর্চ্যুতির শংকায় ফিরে আসছি মুল প্রসঙ্গে। পাঠক সিলেট-ছাতক রেলওয়ে লাইনটি চলে গেছে খাজাঞ্চী গাঁও রেল ষ্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্ব দিয়ে।রেল ষ্টেশন সংলগ্ন দক্ষিণ দিকের গ্রামটি হচ্ছে গমরাগোল (সর্বত্র প্রকাশিত ও পরিচিত) নামের ঐতিহ্যবাহি বৃহৎ একটি গ্রাম।কিন্তু এখানেও রয়েছে চারটি পাড়া বা মহল্লা নিয়ে গঠিত বৃহত্তর গমরাগোল গ্রামটি।পাড়াগুলির নাম হচ্ছে যথাক্রমে পূর্ব পাহাড়পুর, তিলকপুর, পশ্চিম কৃষ্ঞপুর ও গমরাগোল। আমাদের আজকের লেখার মুল নায়ক হচ্ছেন মরহুম মজমিল আলী।পশ্চিম কৃষ্ঞপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মরহুম মজমিল আলী (মজই) ১৯৫০ সালের ১লা মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন।মরহুম জহুর আলী ও মরহুমা কাছনি বিবি দম্পতির দুই কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান হচ্ছেন মরহুম মজমিল আলী (মজই)।পরিবারটি ছিল কৃষি কাজের সহিত সম্পৃক্ত।তাছাড়া সন্নিকটবর্তী কোন স্কুল না থাকায় মজমিল আলী (মজই) লেখাপড়া করেননি।শৈশব পেরিয়ে কৈশোর কাল অতিক্রম করেন গ্রামীণ পরিবেশে থেকে।স্বাভাবিক ভাবেই মা-বাবার আদর যত্নে প্রতিটি সন্তানই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মরহুম মজমিল আলী (মজই) ও স্বাভাবিক ভাবে একজন পরিপূর্ণ যুবকে পরিণত হন কৃষিকাজ করে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা অর্জনের পথে শক্ত বাঁধা হয়ে দাড়ায় পাকিস্তানের হানাদার খ্যাত কুখ্যাত ইয়াহিয়ার আধুনিক সমরাস্ত্র সমৃদ্ধ সশস্ত্র পাকবাহিনী।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা থাকা সত্তেও নানান টালবাহানার মাধ্যমে দিনাতিবাহিত করে ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর লেলিয়ে দেয় সামরিক বাহিনীকে।শুরু করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ।বাংলার মানুষ গর্জে উঠে, প্রতিরোধ করার পন্থা খুজে বিভিন্ন ভাবে।মজমিল আলী (মজই)তখন একুশ বছরের একজন ঠগবগে যুবক। তরুণের তারুন্যে উচ্ছ্বসিত।বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন সমর্থক।একজন নিরক্ষর মানুষ। ১৯৭১ সালের ২৬ শে এপ্রিল সন্ধ্যার পরক্ষনেই আগমন ঘটে পাকবাহিনীর অত্র এলাকায়।তারা হানা দেয় বিভিন্ন গ্রামে। প্রথমেই পাহাড়পুর গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা লিলু মিয়াকে ধরে নিয়ে যায় তিনির নিজ বাড়ি থেকে। অত:পর চলে যায় পার্শ্ববর্তী নুর পুর গ্রামে আওয়ামীলীগের নেতা পল্লী চিকিৎসক ডা: আব্দুল করিমের বাড়িতে।তিনির বাড়িতে অতর্কিতে হানা দিয়ে ধরে ফেলে ডা: আব্দুল করিম ও রন দাস নামক সিলেট শহরের একজন বাসিন্দাকে। যিনি এসে ছিলেন সিলেট শহর ছেড়ে গ্রাম্য পরিবেশে পাকবাহিনীর কবল থেকে নিরাপত্তাজনিত কারনে শশুড় বাড়িতে।“যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়”।রন দাসের ক্ষেত্রেও হল তাই। তারপর ঘাসিগাঁও এর মরহুম আলহাজ ছমরু মিয়াকে (প্রাক্তন সেনা সদস্য)গ্রেফতার করে। সর্বশেষ হানা দেয় গমরাগোল খ্যাত পাড়া নামে অভিহিত পশ্চিম কৃষ্ঞপুর গ্রামে।পেয়ে যায় মজমিল আলীকে (মজই)।ধরে নিয়ে যায় এ পাঁচজন তরুণকে সিলেট ক্যাডেট কলেজে।তখন ক্যাডেট কলেজ ছিল পাকবাহিনীর হেড কোয়ার্টার।চলে অবর্ণনীয় অত্যাচার, নির্মম ও নিষ্ঠুর নিযার্তন।মজমিল আলী (মজই) ধৃত হবার কয়েক বৎসর পূর্বে মা মারা যান।পিতা জহুর আলী ছিলেন অসুস্থ।আমি স্বচক্ষে দেখেছি মজমিল আলীর (মজই)পিতার আহাজারী, কান্না ও ব্যথিত বেদনার অশ্রুপাত।কারন পিতা জহুর আলীর মাথায় ছিল একটি টিউমারসম ফোঁড়া। প্রতিদিন ডেটল দিয়ে ধৌত করতে হত। আর এ কাজটি করতেন তরুণ মজমিল আলী(মজই)।মজমিল আলী (মজই)বন্দি শিবিরে থাকায় তিনি ছিলেন অসহায়। একদিকে রোগ যন্ত্রণা, অপরদিকে তরুণ ছেলের বন্দি জীবন।ছেলেকে ফিরে পাবার কোন রুপ আশ্বস্থতা, নিশ্চয়তা মোটেই ছিল না বিধায় নিরাশা, হতাশার কালোমেঘে ছিল পিতা জহুর আলীর আকাশ ধুয়াশাচ্ছন্ন।বসে থাকতেন অনেক সময় একাগ্রতায় নিমগ্ন।জিজ্ঞাসিলে বলতেন, আমার ছেলেটাকে কি দেখতে পারব না?কত দারুণ আক্ষেপ ও হতাশাব্যঞ্জকতা।এখানে বলে রাখা ভাল, মজমিল আলী (মজই)বন্দি শিবিরে থাকাকালীন সময়েই একদিন পিতা জহুর আলী ইহলোক ছেড়ে পরলোকে চলে গেলেন না দেখার বেদনা নিয়ে। বন্দি শিবিরে এ পাঁচজন তরুণকে ব্যবহার করা হত অস্ত্র বহনের শ্রমিক রুপে, পাকসেনাদের রক্তের প্রয়োজন মেটানো হত গ্রুপ মিলিয়ে যখন তখন রক্ত দাতার ভুমিকা পালনার্থে।কখন চোখ বেঁধে রাখা হত,ওরা দেখেছেন অনেক বাঙ্গালীকে আনা-নেয়া করতে চোখ বেঁধে,তবে তাদের পরিণতি রয়েছে অজানা, অদেখা ও অজ্ঞাত।বন্দিরাও জানতেন না একদিন তাঁরা ফিরে আসবেন বলে।কত হতাশা পূর্ণ ছিল তাঁদের বন্দি জীবন। স্বাধীনতা অর্জনের কিছুদিন পূর্বে জালিম টিক্কা খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় চলে আসেন ফিরে নিজ নিজ বাড়িতে।নিরাশায় আশার আলো।কত না ছিল আনন্দদায়ক সে মুহুর্তটি।তবে তাঁদের ফিরে আসা আনন্দের হলেও বাকি জীবন কাটাতে দেখেছি তাঁদের নির্জীবতা। নেই সেই তারুণ্যের তারুণ্যপূর্ণ জীবনাচার। সকলের মধ্যে ছিল একটি বেদনার ভয়ার্ত চেহারা।কারন শরীরের সবচেয়ে মুল্যবান উপাদান রক্ত প্রদান করে তা কি আর আসে ফিরে?পূরণ করার অনেকের সামর্থ্যও ছিল না।মজমিল আলী (মজই) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। দারিদ্রতা ছিল নিত্য সঙ্গি।বড্ড কষ্ট ও অবহেলাকে সঙ্গি করে বিগত ১৮ অক্টোবর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে মজমিল আলী (মজই) এ দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন।ইন্না…..রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী,চার ছেলে ও তিন মেয়ে।মজমিল আলী (মজই) এর তৃতীয় সন্তান মাওলানা জামাল উদ্দিন পশ্চিম সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সৎপুর দারুল হাদিছ কামিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে পাগড়ী প্রাপ্ত হন।অপরাপর সন্তানরা তেমন লেখাপড়া করতে পারেননি।এ সকল বন্দিদের কেহ কখনও নেয়নি খবর, রাখেনি খোজ। কারন ওরা মুক্তিযোদ্ধ করেনি হাতে অস্ত্র তোলে, প্রশিক্ষিত হয়ে। আবার হানাদার বাহিনীর সহযোগিতার খাতায় নাম লেখায়নি কখনও দোসর সেজে।তবে বাংলাদেশের লাল পতাকা, স্বাধীনতা অর্জনের প্রাক্কালে এ দেশের একজন নাগরিক হিসাবে বন্দীত্ব জীবন কাটাতে হয়েছে পাক হানাদারদের হাতে এ এক চরম সত্য কথন।জানি না কোন অভিধার অন্তর্ভুক্ত তাদের এ দু:সহ বেদনা বিধুরতা। পাঁচজন বন্দিকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান প্রদর্শন করা আমার মনে হয় বিবেচনার দাবী রাখে।ওরা কেহই জীবিত থাকাকালে কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। আমি আশা করি মরণোত্তর সম্মান পেলে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।আমি মহান আল্লাহর দরবারে তিনিসহ অপরাপর বন্দিদের এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল শহীদানের আত্মার মাগফেরাত ও জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দানের প্রার্থনা করি নিরন্তর। লেখক- মিজানুর রহমান মিজান সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব,বিশ্বনাথ, সিলেট।.
ডে-নাইট-নিউজ / মিজানুর রহমান মিজান
আপনার মতামত লিখুন: