আমার বাবা
মিজানুর রহমান মিজান .
সত্য,সুন্দরের পূজারী ,সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক,বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন মরমী বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া। সিলেটের মরমী আকাশের এক উজ্জল নক্ষত্র। তাঁকে বাউল এবং বাউলার কালের একজন আদর্শ শিল্পী,গীতিকার ও খ্যাতিমান সুর ¯্রষ্ঠা হিসাবে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী সাধনার মানস পুত্র রুপে মননশীল পাঠক ও সংবেদনশীল শ্রোতাদের হৃদয়ে স্বতন্ত্রবোধে ঠাই করেছিলেন আপন ভূবন সৃষ্ঠিকারীর ভ’মিকায়। যাঁর গান ও সুর ভাবুক হৃদয়ে অকৃত্রিম ভাব গাম্বীর্য সৃষ্ঠির তোলপাড়ে নিরানন্দ মানুষ পেত অনাবিল আনন্দের স্বচছ ¯্রােত ধারা সম্পন্ন এক মোহনা। তাঁর গানের চাহিদা ,গুরুত্ব এবং অশেষ সুখ্যাতির শীর্য পর্যায় ছিল “কলের গান“(গ্রামোফোন) প্রচলন থেকে টেইপ রেকর্ডার এর আমাদের দেশে প্রচলনের প্রারম্ভিকতায়।.
তৎকালীন সময়ে তাঁর গান ব্যতীত টেইপ রের্কডার কল্পনা করা ছিল দ:ুসাধ্য,দুষ্কর অত্র এলাকায়। তিনির সুললিত কণ্ঠের আবেগ মাধুর্য ম-িত গানে গানে শ্রোতারা বিমুগ্ধ হতেন ভাবালুতার অনন্য প্রভাবে। মরহুম চাঁন মিয়া জন্ম গ্রহণ করেন সিলেট জেলার পার্শ্ববর্তী জনপদ বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের জয়নগর (নোয়াপাড়া) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভাইবোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ থাকায় অতিরিক্ত আদর ¯েœহের পরশে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাবার সুযোগ নতুন মাত্রা যোগ। ধনীর আদুরে দুলাল এবং তখনকার সময় পরিবেশ এত ব্যস্ততম ছিল না বলে কাজ কর্মের পরিধি ছিল সীমিত এবং অফুরন্ত অবসর । লেখাপড়ার ছাপ বা সদিচছা ছিল কম। তাই প্রাথমিক শিক্ষা শেষে লেখাপড়ায় যবনিকাপাত ঘটে কঠিন দেওয়াল সমতায়। কৈশোরের উচছ¦লতায় গ্রামোফোন কিনে বাজাতেন অতি আগ্রহে । গ্রামোফোনের কদর এতই বেশী ছিল যা রসিক চিত্তের বিত্তবানরা হৃদয়ের সজীবতাকে ধরে রাখতে দলবেধে বসে শুনতেন আন্তরিকতায়। এ থেকে শিল্পীর গানের প্রতি ঝোঁক বেডে যায় । এক সময় তিনি গুন গুন সুরে গাইলে ও প্রবৃত্তির সাহসিকতায় হাতে তুলে নেন দুতারা,হারমোনিয়াম,বেহালা,শুরু হয় সাধনা। সাধকের তপস্যা কোনদিন বৃথা যায় না,যদি হয় তা হৃার্দিক।
পারিবারিক সংস্কৃতি ছিল তখন রক্ষণশীল। তৎকালীন সময়ে অত্যধিক পরিবার এ তালিকান্তর্ভুক্ত ছিল। তথাপি শত বাধা ও প্রতিকুল আবহাওয়ায় কঠিন দেওয়াল টপকে কঠোর সাধনায় সাফল্যের চরম পর্যায়ে পৌছেন। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিচরণ করেন উজ্জল নক্ষত্র রুপে,মঞ্চ কাপানো ব্যক্তিত্ব হিসাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ভক্ত ও ভাবুক হৃদয়ে তোলপাড ,আলোড়ন সৃষ্ঠিকারী রুপে। ¯্রষ্ঠা ও সৃষ্ঠির প্রেমের যোগ সুত্রসহ নিজেকে সমর্পণের আকুল মিনতী ব্যক্ত যখন প্রকাশিতের ভাবুকতায় সুর তুলতেন,“আমি অধম পাথকী , জোড় হস্তে তোমায় ডাকি , কর সুখি দেখাইয়া দিদার “অথবা “সাহারাতে ফুটলরে ফুল,দুজাহানের বাদশা মকবুল,ভ্রমর আকুল গন্ধ পাইয়া তার“ ও ‘ক্ষণস্থায়ী এ জগতে রবে না কেউ চিরকাল,আশা যাওয়া বিফল হইল পারের কড়ি নাই আমার“ বা “সব খোয়াইলাম কামিনীর হাঠে , একদিন ধরিবে জমদুতে“ অথবা “একদিন নবী গেলেন সংসার ছাড়ি, কইতে না পারি“।.
দর্শক শ্রোতা বিমুগ্ধ ভাবুকতায় হতেন বিভোর। করতেন অবগাহ অমিয় ধারা মোহনীয় সিক্ততায়। নিরানন্দ মানুষের প্রাণে আনন্দ সঞ্চারিতের বলিষ্ঠ এক মাধ্যম ছিলেন শিল্পী বাউল চাঁন মিয়া। তখনকার শ্রোতারা ,গানের অনুরাগী ,ভক্তরা আজো তাহাঁর তম্ময়পূর্ণ সুরের প্রতিধবনি স্মৃতির এ্যালবাম থেকে স্মরণে বিমূর্ত আবেগ ,উচছ¦াস হৃদয়ে ধারন করেন সযতেœ। শ্রোতারা অনেক দূর যেতে কষ্ঠ অনুভব হত না গায়ের মেঠো পথ পায়ে হেঠে নিঝুম রাতের আধার পেরিয়ে। ফলে আজো অনেক ভক্তের নিকট তিনির গানের ক্যাসেট রক্ষিত ছিল, অতি আদরে ,সযতেœ তার।কিন্তু আধুনিকতার ছাপে টেপরেকর্ডার বিলীন হবার সুবাদে ক্যাসেট প্রাপ্তি হয়ে পড়েছে দুরুহ। “নো চিন্তা ,ডু ফুর্তি“ প্রবাদ বাক্য ছিল তার জীবনের একনিষ্ঠ সাধনার তালিকায় এবং মহান রাববুল আলামীনের উপর ছিলেন অগাধ নির্ভরশীল বিশ্বাসী। আল্লাহ প্রেমের ভাবুকতায় তিনি যখন সুর ধরতেন,“ডাকি আমি কাতরে,রহম কর আমারে, ওগো রহমানুর রাহিম আল্লাহ“বা “গরীব হইলে ভবে কেউ চিনে নারে গরীব, ও ভবের গরীব । গরীব ধনীর বাড়ীত যায় .. ..করে ভাবনা“ অথবা “হরিণী কাদিয়া বলে,পড়িয়া শিকারীর জালে, তরাইয়া নেও আমারে নবী মোস্তফায়“। শ্রোতারা তম্ময় হয়ে ভাব সাগরে নিমজ্জিত হতেন পিন পতন নিরবতায়। ¯্রষ্ঠার নিকট সৃষ্ঠি যেন একাকার আত্ম সমর্পনের মধ্য দিয়ে বিনয়াবনত চিত্তে সর্বত্যাগী রুপে। সুরের ঝংকারে ভাব সাগরে উত্থোলিত হত ক্রমাগত ঢেউ অপূর্ব করুন নাটকীয়তায়। ¯্রষ্ঠার নিকট নিজকে সমর্পনের ব্যাকুলতা আধ্যাত্মিক মিলনের ,আগ্রহের আর্তি সহযোগে।
অর্থের মোহ বা আভিজাত্যের মোহ ছিল না বলে আদর্শিক চরিত্র সম্বলিত সরল জীবন যাপনের প্রতি ছিলেন অধিক আগ্রহী।.
সারলিক যাত্রা পথে অনেক বিপত্তি তিনি নিরব ত্যাগ-তিতিক্ষা অসীম ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবিলায় বুকে কঠিন পাথর চেপে যেতেন । নিত্য সঙ্গী ছিল পরিষ্কার-পরিচছন্ন, ,পরিপাটি ও শুভ্র পোষাক। এতে করে শুভ্রতা সম্পন্ন মননশীল হওয়া অনায়াস লভ্য বা লক্ষণ বলে ছিল তাঁর ধারণা । ২০০০ সালের প্রথমার্ধে ক্যান্সার নামক মহাঘাতক তাঁর কণ্ঠে বাসা বাধে শক্ত সামর্থ্য।ে কিন্তু সৃষ্ঠিকর্তার অপার বিস্ময় এক বৎসর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থতা ফিরে আসে। চলাফেরা করেন স্বাচছন্দ্যে। কিন্তু ২০০৪ সালের ।ঈদুল ফিতরের ২ দিন পূর্ব থেকে আবারো ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সন্ধ্যা ৫-৫৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নাল্লিাহি.. .. ..রাজিউন)। তিনি এক পুত্র ও ৫ কন্যাসহ অনেক আত্মীয়- স্বজন ,অনুরাগী রেখে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন নিজস্ব গোরস্থানে । তাঁর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগনিত গানের ক্যাসেট সংগৃহীত হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের অত্যাবশ্যকীয় বলে আমার বদ্ধমুল ধারনা। আমি তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি ঐকান্তিক হৃদয়ানুভুতির সহিত বিন¤্র করজোড়ে মহান আল্লাহর দরবারে।
.
লেখক মিজানুর রহমানমিজান। .
সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেস ক্লাব,
প্রতিষ্টাতা ও পরিচালক চান মিয়া স্মৃতি পাঠাগার,
রাজাগঞ্জ বাজার, বিশ্বনাথ, সিলেট।
.
.
ডে-নাইট-নিউজ / আমার বাবা : মিজানুর রহমান মিজান
আপনার মতামত লিখুন: