পৌরাণিক লোক কাহিনী কিংবা কয়েক যুগ আগের অথবা সদ্য রচিত গল্প গুজব শুনেননি এমন নারী পুরুষ খুবই কম পাওয়া যাবে সমাজে। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত সবাই শুনেছেন। তবে কেউ যদি বলে শুনেননি; তা হলে ধরে নিতে হবে ঐ ব্যক্তি বধির। বধির সে, যে কানে শুনে না।.
ইতিহাসের পেঠ ভরে আছে অগণিত গল্প ঘটনা ও কাহিনীর সংযোজনে। ইতিহাস হাতিয়ে ঐসব কাহিনী, ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখি এবং জানি। বাস্তবতাও হলো এই যে, এসব থেকে রয়েছে পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভের ব্যবস্থা। আজ কিংবা কিছুকাল আগের ব্যক্তি কেন্দ্রিক ঘটনা, সামাজিক ঘটনা, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট মলাটবন্ধি করার একটাই উদ্দেশ্য থাকে যেটা ভবিষ্যাত প্রজন্মকে অতীত ঘটনাগুলো জানান দেওয়া। কাগজের গায়ে যারা কলম ঘষেন তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তি বা স্বাতন্ত্র্য কারুকাজে ভবিষ্যাৎ মানুষের কাছে ইতিহাস পৌছে দেওয়ার চেষ্টা কখনো কেউ কম করেননি। তাতে কেউ সফল ও জনপ্রিয়, কেউ অবহেলা অনাদরে থাকেন, যেটা নিয়তির দান বলে মেনে নিতে হয়, মেনে নেওয়া আবশ্যক। যাই হোক- লোক কাহিনী ও পল্লীকাহিনী এ বিষয়গুলো বাঙ্গালী সংস্কৃতির সম্পদ। এ সম্পদে বাঙ্গালীর ইতিহাস সমৃদ্ধ। যে সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে জ্ঞান পিপাসুরা প্রতিনিয়ত জ্ঞান সঞ্চয় করে নিজের জন্য। পরতে পরতে অতীত লোক কাহিনীর চরিত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মঙ্গল ও উপকারিতা এনে দেয়। বেশি কিছু না দিলেও একটু বিনোদন দিতে পারে। সব গল্প সবার ভাল লাগেনা ও মনমত হয়না। যাক আজ আমিও একটি লোক কাহিনী কাগজে স্থান দিতে যাচ্ছি যার বাস্তবতা শতগুণ সত্য। আশা করি পাঠকের ভাল লাগবে। তবে সে কাহিনীর বাস্তবতা কারো জীবনে না আসুক তা কামনার ঝুড়িতে প্রত্যাশিত। অনুরোধ করছি এর সাথে মিল খোজার চেষ্টা করবেন না কেউ। কারো জীবনে মিল পেলে তা কাকতালীয় ব্যাপার।.
আরো কিছু বলতে হচ্ছে- যা আমার বদঅভ্যাস। যে অভ্যাসটি হলো কিছু লিখতে গেলে মূল বিষয়ের চেয়ে ভূমিকা অধিক লম্বা করে ফেলি। ভুমিকা ও উদাহরণের মাত্রা দীর্ঘ করে লেখনি ও প্রকাশের বিষয়ে মুল মন্ত্র, লেখার শ্রী, মান বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে যা পাঠক বিরক্তির ও একটা উল্লেখযোগ্য কারণ। এ অপরাধ এবং ত্রুটির কারণে আমি ক্ষমাযোগ্য নই তবুও পাঠকের প্রিয়তে স্থান পাব আশা দীর্ঘায়িত জীবন প্রদীপ পর্যন্ত। ' বাদির হাতে মেহেদী ' নামে লেখাটি একটি ছোট গল্পকারে সমাপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখব এ প্রতিশ্রুতি আজ আগাম। আধুনিক সভ্যতায় আজ রাজা বাদশাহীর শাসন ও নিয়ম নীতি নেই। অনেক দেশে রাজা প্রজা সবাই সমান। বাদশাহী সালতানাত ও রাজ দরবার, রাজ পরিবার, রাজ কর্মচারি সবই হয়েছে কালের গর্ভে বিলীন। রাজাদের রাজদরবারে আগে যে দাস-দাসী ও সেবক সেবিকা শ্রেণীর অনেক নারী পুরুষ থাকতো, বসবাস করতো তা আজ আর নেই।.
এক কথায় রুম সাম্ররাজ্য, আরব্য সালতানাত থেকে শুরু করে পারস্য ও এশিয়া পর্যন্ত যত বাদশাহী দরবার ছিল আজ সব বিলুপ্ত হয়েছে গণতন্ত্রের বিল্পবী জাগরণে। দাস-দাসী, প্রভু-ভূত্যের ও মৃত্যু হয়েছে সমধিকার ও শ্রেণী বৈষম্যহীনতার বিবেক জাগ্রত হওয়ার কারণে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সমধিকার তন্ত্র সত্যি সত্যি আর্শিবাদপুষ্ট মানুষ মানবতার মুক্তির জন্য। শোষন শাসনের হাত থেকে মানুষের মৌলিক অধিকার আজ কিছুটা হলেও মুক্ত, রক্ষিত। দাস দাসী, প্রভু ভূত্যের ছায়া ভবিষ্যতে আর কখনো যেন ফিরে না আসে অভিশাপের মত কিংবা দানবের মত এই চাওয়া, বর্তমান সভ্য সমাজের সকলের চাওয়া। তবে শ্রেণী বৈষম্য ও আধুনিক জগতে আধুনিক দাস দাসী যে নেই তা নিশ্চিত বলা যায় না। এখনও নব্যতালে দাসদাসীর প্রথা চালু আছে। শুধু একটু ধরণ পাল্টেছে। এই আধুনিক দাসদাসীর কর্মস্থল এখন উচ্চবিত্ত পরিবার আর রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তার ঘর, বাসা-বাড়ি আর অফিস আদালত। আধুনিক দাসদাসীর নামটাও একটু আধুনিক হয়েছে যেমন; কাজের মেয়ে-ছেলে, ভূয়া, আয়া, পিএস, এপিএস ইত্যাদি।.
দাসীবাদিকে আঞ্চলিক ভাবে ডাকা হয় "দাসী-বান্দি "। আমার এলাকার কথাই বলি ; বাদি শব্দকে 'বান্দি' ডাকা হয়। বান্দি শুদ্ধ না বাদি শুদ্ধ, বাদি শব্দ থেকে বান্দির উৎপত্তি না বান্দি থেকে বাদির উৎপত্তি তা আমি নিজেই জানি না। তবে এতটুকু বুঝেছি; যারা এপর্যন্ত কোনো বড় লোকের বা বিত্তশালীর ঘরে কাজকর্ম করে তাদেরকে আগেকার রাজ পরিবারের দাসদাসীর সাথে উপমায় যুক্ত করে এখনও ডাকা হয়, গ্রামের সহজ সরল মানুষ এখনোও ডাকেন সম্বোধন করে যান। ঝি, ভূয়া, আয়া নাম ধারণ এখনও স্বার্থকতা লাভ করতে পারছেনা এ কারণে যে, এখনোও শ্রেণীবৈষম্যের যবণিকাপাত পুরোপুরি হয়নি সমাজ থেকে। আগের রাজ পরিবার যেমন অধিনস্থ কর্মচারির উপর প্রভুত্ব কর্তৃত্ব আরোপ করত এখনো তার লেষ ( উচুতলার) ধনি শ্রেনীর মাঝে প্রতিয়মান। আগের থেকে এখন অধিনস্থ কর্মচারির নামের সাথে যেমন নতুন ডাকনামের সংযোজন হয়েছে তেমনি ভবিষ্যাতে শ্রেণী প্রথার বিলুপ্তি সাধিত হয়ে নতুন নব্য দাসদাসীর নিচু শাব্দিক নামের মৃত্যু ঘটবে চিরতরে এই প্রত্যাশাই করি। বাঙ্গালী সমাজে শ্রেণী বৈষম্য প্রসঙ্গ যদি বলতে হয় তাহলে কয়েকটা পুস্তক রচনা সম্ভব তাই সেদিকে আমি আর যাচ্ছি না। 'শ্রেণী বৈষম্য ও সমাজ ব্যবস্থা ' নামে প্রকাশিত আমার একটি প্রবন্ধ আছে। যাই হোক আধুনিক সমাজের এক বাদির কথাই আজ বলি।.
হাজী সাত্তার মিয়া নামের লোকটি পাখিপুরে বসবাস করতেন। তাকে সবাই হাজীসাব বলে ডাকত। হাজীসাব হিন্দু মুসলিম সবার কাছে এক দেবতাতুল্য। দেবতা তুল্যের কারণও আছে। এলাকার সবচাইতে ধনী লোক তিনি। মাসে তিনচারটে গো শিন্নি লেগেই থাকত তার বাড়িতে। আপদ বিপদ কিংবা মুর্দেগানের মৃত্যু তারিখে কোরআন খতম দিতেন, গরু জবাই করে শিন্নিও করতেন। আশপাশের কয়েক গ্রামের গরীব ধনী এসে খেতো তৃপ্তি সহকারে। গো-হাল ছিল কমকরেও পাঁচ ছয়টি। বারো মাস কাজের লোকের সরব উপস্থিতিও ছিল। দৈনিক, মাসিক, বাৎসরিক দশ বারোজন কামলা খাটতো তার রাজত্বে। দান খয়রাতও ভালই করতেন। জমির ধানে বছর ঘুরে উদ্বৃত্ব থাকতো হামেশা। কৃষিতেই যেন তার সোনা ফলে বার মাস। আউশ আমন আর ইরি ধান পুরু গ্রামের ঘরে যা উঠতো ততটুকুর বেশি হতো তার। এক কথায় অভাব অনটন বলতে কিছুই ছিল না; যেন সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিলেন। অঞ্চল জুড়েই তা নাম ডাক। অনেকটাই জমিদারীর মতো তার সহায় সম্ভল। কৃষি জমির উদ্বৃত্ত ধানের পয়সায় প্রতি বছর এক দুই একর জমিও ক্রয় করতেন। অভাব অনটনে পড়ে এলাকার যে কেউ এলে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। একবার কর্য নিয়ে দ্বিতীয় বার কিংবা তৃতীয়বার এলেও দিতেন। কর্যদার দেনা শোধে ব্যর্থ হলে জমি থাকলে জমি না হয় শ্রমিক খেটেও পরিশোধের সুযোগের কমতি ছিলনা হাজীসাবের দরবারে। পাঁচ ছয় গ্রামের কতলোক যে তার ঘরে কামলা খেটেছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। নিজ গ্রামেরও হতদরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত অনেকেই হাজীসাবের কামলা খেটেছে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে।.
বেলা বাড়ার সাথে সাথে তিন চার জন বাঁশের তৈরি ছাতা মাথায় করে গরু নিয়ে মাঠে যেত। সন্ধ্যার আগে ফিরত গোয়ালে। কাজের লোকের থাকার জায়গাও ছিল আলাদা। বারমাইয়া (বারমাসি) কামলাদের জন্য ছিল তিন বেলা খাবার ব্যবস্থা। সিলেট অঞ্চলে ডাল ভাতের নাম ডাক না থাকলেও হাজীসাবের বাড়িতে ছিল খুবই উজ্জ্বল। মুসলিমদের পাশাপাশী হিন্দুরাও হাজীসাবের কাম করত দ্বিধাহীন। কাজে কোনো জাতপাত, ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী তারতম্য এত কিছু হাজীসাবের কাছে ভাবার উপকরণ ছিলনা। তিনি কাজ করাবেন, আর যে করবে সে হিন্দু না মুসলমান তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা তার নেই। তিনি ইচ্ছামত মজুরি নির্ধারণ করতেন। তার নির্ধারিত মজুরি অনুপাতে এলাকার অন্য নিম্মবিত্ত বা মধ্যবিত্তরা কামলাকে মজুরি প্রদান করতেন। কাজের লোকেরাও সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন। এর একটা যতেষ্ট কারণও ছিল। হাজীসাবের নির্ধারিত মজুরি গ্রহন না করলে অন্যত্র পর্যাপ্ত কাজ কর্ম জুটবেনা বরং সন্তান সন্ততি নিয়ে আহার -অনাহারে দিন কাটাতে হবে। মাঠ ঘাটে কাজ করে পুরুষ আর বাড়িতে আছে ঝি-জায়া ও মহিলারা। রান্নার কাজ থেকে ধানপান ঘোলায় উঠানো পর্যন্ত কাজের মহিলারা করতো। সিলেট অঞ্চলে সবখানে মহিলারা শ্রমিক কিংবা কামলা খাটে না যতক্ষণ তার পরিবারের সর্বশেষ একজন পুরুষ উপার্জন করতে সক্ষম থাকে।.
সর্বোচ্চ যদি পনের বিশজনের পরিবারও হয় তবুও খেয়ে না খেয়ে দিন পার করবে কিন্তু মহিলারা বাড়ির বাহিরে রুটি রুজিতে পা দেবে না। এটা এক ধরনের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। কিন্তু যাদের পরিবারে একেবারে পুরুষ লোক নেই, কিংবা আছে কর্ম করতে পারেনা তাদের ক্ষেত্রে মহিলারা রুটি রুজিতে বেরুয়। তাও অনেক নিয়ন্ত্রিত নিয়ম বিধি মেনে। একসাথে তো সব পরিবার নিরুপায় হয়ে পড়ে না। গাও গেরামের দুই এক পরিবার বিপদ মুচিবতে ও দূর্ঘটনার শিকার হয়ে কাজ কর্মতে যোগ দিতে হলে গ্রামেরই বিত্তশালীদের ঘরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়। গ্রামে এমন পরিবেশ না পেলে তখন অন্যত্র রুজির জন্য ঘর পালালে কোনো আপত্তি থাকে না কারো। সুখে দুঃখে পঞ্চায়েতি বন্ধন, বিধি নিষেধ সমাজটাকে সুশৃংখল রাখতে সর্বাগ্রে সাহায্য করে। পুরুষহীন পরিবারের ভরন পোষন এর দায়িত্ব অনেকটা গ্রামের মানুষের কাঁধে বহন করে। ছদকা যাকাত, সাহায্যের সিংহভাগ আগে ভাগেই উপার্জনাক্ষম পরিবারের হাতে অর্পন করা হয় যা দিয়ে বিপদ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় গরীবেরা। যাক হাজীসাবের কথা বলছিলাম। তার পরিবারে পাঁচজন মহিলা কাজের লোক রয়েছে। পাঁচ জনের মধ্যে একটি নয় বছরের কিশোরী মেয়ে। ভাগ্যের চাকা তাকে হাজীবাড়িতে নিয়ে এসেছে। নয় বছর বয়সে যে মেয়েটি স্কুল আঙ্গিনায় পাঠ চুকার কথা ; সে কিনা মায়ের জন্য, ভাই বাবার জন্য খাদ্যের যোগান দিতে দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়।.
মেয়েটি কাজের উপযুক্ত না হলেও হাজীসাব বিবেকের দায়বদ্ধতায় তাকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। মেয়েটি এটা ওটা ফরমাশ আর উঠুনে লাকড়ি শুকিয়ে দিন পার করে। সকাল বেলা সে এক বোল ভাত আর পরিমাণ মত ডাল পায়,, যা দিয়ে তার এক ভাই, বাবা মার সকালের খাবার যোগান হয়। রাত দশটা কিংবা এগারটায় পায় আরো ততটুকু। ডাল আর ভাত নিয়ে প্রতিদিন রাতে সে ঘর ফিরে। বাড়িটি তার হাজীসাবের বাড়ি থেকে এক বাড়ি পূর্বে। রাত বেশি হলে তার মা তাকে এগিয়ে নিয়ে আসেন। ভাইয়ের বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। তার বাবাও হাজীসাবের ঘরে বছর কামলা ছিলেন। ট্রাইফয়েড তাকে কর্মঅক্ষম করে দিয়েছে। রোগটাও এসেছিল কাজের দখল সইতে না পারায়। ভাদ্রমাসের দিনভর বৃষ্টি আর রাতে প্রচন্ড বাতাসের দখল সইতে পারেন নি। বয়স ঘেটে লোকটি বিয়ে করেছিল নইলে আজ মেয়ে ছেলে দুটো পূর্ণ রোজগার থাকতো। বউ এখনো তার কাচা মাছ। দেখলে মনে হয় এখনও যৌবতির বিয়েটাই হয়নি। এমন যুবতি মেয়েরা রুটি রুজিতে বাহিরে বেরুলে গাও পঞ্চায়েত মন্দ বলে। তাই নয় বছরের মেয়ে শ্যামলীর গাঢ়ে তাদের ভরন পোষনের বোঝা বইতে হচ্ছে আজ দুবছর ধরে। ক্লাশ থ্রি-তে পড়তো শ্যামলী। পড়াতে খুব ভাল ছিল সে।.
পড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। গায়ের রং শ্যামল বর্ণের বলেই নাকি নামটিও শ্যামলী রেখেছেন মা বাবা আল্লাহই ভাল জানেন! দিনভর কাজ করে আর নিজেকে নিয়ে ভাবে। মা বাবার জন্য তার খুব কষ্ট হয়। সিদু, জুই, মিনার, রাজু, নিশিতা, বুরহান, মুহিব ওরা রোজ রোজ পাঠশালায় যায় কত আনন্দ করে। টিপিনে কানামাছি, দাড়িয়াভাঙ্গা, ইচিং ভিচিং কত কি খেলে। দ্যুাৎ আমার কপালটাই খারাপ বলে মনকে হালকা করে শ্যামলী। জুই, মিনার ওরা শ্যামলীর প্রতিবেশি। একসাথে পড়তো শ্যামলী। ওদের কথা স্মরণ হলে খুব মন খারাপ লাগে তার। বারান্দায় পাকার খুটিতে হেলান দিয়ে চোখের জল মুছে। রাতে ফাঁক পেলে রাব্বি, জালাল আর হাবিবার পড়ার টেবিলের পাশে এসে দাড়ায়। রাব্বি জালাল হাবিবা ওরা হাজীসাবের ছেলে মেয়ে। ক্লাশ সিক্স- সেভেন আর এইটে পড়ে ওরা। হাজীসাবের আরেক ছেলে আছে কামাল নামে। কামাল শহরে বাসায় থেকে কলেজে পড়ে। শ্যামলী পাশে এলে জালাল তাকে নিয়ে কথা বলে। সবার চাইতে বেশি আদর করে একমাত্র জালালই।.
কাজের মেয়ের ফুরসত হওয়া নেই ভেবে হাজীসাবের অন্য ছেলে মেয়ে স্ত্রী সবসময় তাগাদা আর একটা কাজ শেষ হবার আগে আরেকটা কাজের ফরমাশ দিয়েই রাখেন। স্ত্রী নয় যেন জল্লাদ। এ নিয়ে হাজীসাব অনেক বকেন কিন্তু যার যে আমল সেটা মরলেও পরির্বতন কি আর হয়? সবসময় খাটাসের মত তটস্থ করে রাখেন কাজের মেয়েগুলিকে। পড়ার টেবিলের পাশে দাড়ানোয় শ্যামলী এ পর্যন্ত দুইদিন চুলটান খেয়েছে। কিন্তু পড়া! শ্যামলীকে খুব টানে। জালালের খুব ভাল লাগে শ্যামলীকে। জালাল কারো দুঃখ সইতে পারে না। অভাবী গরীব আর বিপদগ্রস্থদের জন্য সে ভাবে। কখনো ভাবে আমার বাবার এতো সম্পদ কেন? এক জনকে আল্লাহ এতো সম্পদ দেয় কেন? এই সম্পদগুলো একজনের না হয়ে সবার সমান সমান থাকত: তাহলে কেউই অভাব অনটনে থাকত না। নিজের কাজ নিজে করত। অন্যের বাড়িতে কেউ কামলা খেটে ঝাড়িবাড়ি, চোখ রাঙ্গানো খেতে হত না। এই ছোট্ট মেয়ে শ্যামলীও এত কষ্ট করতে হত না। আমরা কত সুখে আছি, ভাল মন্দ কত কিছু খাই কিন্তু ওরা দুমুটো ভাত আর ডালের জন্য কতো কষ্টই না করে।.
কত যুলুম নির্যাতন সয়। শ্যামলীটা কখনো রাত এগারটায় বাড়ি ফিরে ফজর পর ফের চলে আসে। বাসন কোষন মাজে, খড়ি ঠেলে, কাপড় ধুয়, এটা ওটা কত কাজ তার একটু জিরিয়ে নেবার ফুরসত নেই। এটা কেমন সমাজ? কেউ খায় আর কেউ পায় না। শ্যামলীকে সেদিন দশটাকা দিয়েছে জালাল। তার ভাইয়ের খুব জ্বর হয়েছে বলেছিল শ্যামলী। শ্যামলীর দুঃখকে ভাগ করে নিতে চায় জালাল। শ্যামলীর সাথে গল্প গোজব করতে দেন না জালালের মা। অনেক বার বলেছেন দাসীবাদির সাথে এতো মিশো না। ওদের সাথে মিশতে নেই। জালাল শুধু শ্যামলীর সাথে নয় বরং তার স্কুলের ক্লাশমেটদের মধ্যে যারা বেশি গরীব তাদের সাথে বেশি করে মেশে। প্রতিদিনের টিপিনের পাঁচ টাকার নোট আজ একজনকে তো কাল অন্যজনকে আইসক্রিম বা অন্য কিছু কিনে দিয়ে সাবাড় করে। বড়লোকের ছেলে বলে গরীবের কাছে ঘেষবে না এনীতি জালাল অনন্ত মানতে চায় না। মাকে জালালও বলে দিয়েছে দু-বার, সে শ্যামলীর সাথে মেশবে। এর পর থেকে যেমনটি স্কুলের সহপাটিদের সাথে করে তেমনটি সে শ্যামলীর সাথে ও করে। নিজে না খেয়ে পাঁচ দশ টাকার নোটটি শ্যামলীর হাতে গুজে দেয় জালাল। বিকেলে ছোট বোন আর ভাইকে সাথে নিয়ে শ্যামলীকে জড়ায় কানামাছির আড্ডায়। হাজীসাব কখনো বাধা করেন না কিন্তু জালালের মা মরুবালির ন্যায় দেখেন জালালের কান্ডটি। জালাল অত্যান্ত নম্র, ভদ্র এবং ভাবুক প্রকৃতির মানুষ।.
অগ্রাহায়নের ধান মাড়াই'র ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের লুকোচুরিতে কাজের লোকেরা গরুর পেছন পেছন হাটে আর নিচু গলায় কখনো মনের ব্যাথা কষ্ট হালকা ( কইলে যায় মনের দুখ্ ) করার অভিলাষে গান ধরে এসব স্লোক দিয়ে। ' তুমি ধনীরে ধন দিলা গরীবের তুইলা পিঠের ছাল রে দয়াল, এভাবে আর কাটবে কত কাল '। কামলার গলা শুনে দ্রুত অন্য কাজ ছেড়ে শ্যামলী দরজার পাটে অন্ধকারে হেলান দিয়ে চোখের জলে বুক ভাসায়। কখনো জালালও চোখ মুছে। গরীবের কষ্ট দেখলেই তার চোখ জলে ঝাপসা হয়। মনে মনে ভাবে জমিজমার মালিক সে হলে সব বিলিয়ে দিত গরীব মিসকিনদের। আমরা সবাইতো মানুষ, কিন্তু কেউ মালিক কেউ চাকর এটা কেন? কেনো এতো বৈষম্য। শ্যামলীর পরিবার নিয়েও তার প্রচুর কষ্ট হয়। একদিন জালাল তার বাবাকে বললো শ্যামলীদের একটু বেশি করে সাহায্য করতে। ছেলের কথায় হাজীসাব অনেক ভেবেছেন। মানুষের জন্য এত দরদ থাকলে হয় না। ধন সম্পদের পরিচালনা করতে হলে গরীবদের খাটাতে হয় মন শক্ত রাখতে হয়। বাবার কথায় জালাল অনেক কষ্ট পেয়েছে। ছেলের কথা রাখতে গিয়ে হাজীসাব দুইশত টাকার একটি অনুদান শ্যামলীর মাকে ডেকে দিয়েছেন তিনি। জালালের আত্মসম্মানে খুব লেগেছিল সামান্য করুণার ধরণ দেখে।.
জালাল এবার বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে নাইনে উঠেছে। ভাবছে শ্যামলী যদি এযাবৎ পড়াতে থাকতো তাহলে সে আজ থাকত ক্লাস সিক্সে। এতদিন যাবৎ জালাল অনুমান করছে শ্যামলীর পড়ার প্রতি খুব টান। কিন্তু তার মা বাবার বাধার কারনে সে তাকে পড়াতে পারছে না। অবশেষে জালাল শ্যামলীর পড়ার প্রতি টান দেখে প্রতি রাতে তাকে তার পুরাতন ক্লাসের বইগুলো এক ঘন্টা করে পড়ানোর অনুমতি প্রাপ্ত হয় হাজীসাবের নিকট থেকে। শ্যামলীকে পড়তে না দিলে সেও পড়া ছেড়ে দেবে এমন হুমকিই মা বাবাকে সম্মতি দিতে সহজে কাজ করেছে। মাকে অনেক বুঝিয়েছে জালাল, এতটুকু বাচ্চা মেয়ে কে এতো কাজের চাপ না দিতে। বেশি না হলে কিছু কাজে লেগেছে জালালের কথা। জালালকে নিয়ে মা বাবা খুব সন্দিহান ছেলেটি দিনদিন শুধু পরের জন্য ভাবছে কেনো। শেষ পর্যন্ত কি ছেলেটি নব্য হাতেমতাই হয়ে উঠবে। তবে হাজীসাবের মাঝে মাঝে জালালকে নিয়ে গর্বও হয়। পড়াতে অনেক ভাল সে। সবসময় ফাস্ট হয়। আজ ক'দিন থেকে জালালের ফোর এর পুরাতন বইগুলো শ্যামলীকে পড়াচ্ছে জালাল। একবার বলে দিলে আর কিছুই লাগে না শ্যামলীর। পড়ার প্রতি মনযোগ আর মেধাশক্তির প্রখরতা দেখে জালাল অভিভূত হয়ে যায়। দিনদিন শ্যামলীকে নিয়ে জালালের আগ্রহের কমতি নেই তবে এখনো প্রেমের ছোঁয়া উভয়ের মনে লাগেনি।.
প্রেমটেম সম্মন্ধে কোনো জ্ঞানই উভয়ের নেই। বর্তমান যুগের ছেলে মেয়ের ছেয়ে আগেকার ছেলে মেয়েতে এতো অল্প বয়সে প্রেম প্রেম হতনা। শ্যামলীর হাতের লেখা খুব সুন্দর। অংকে খুব দখল আছে তার। অস্তে অস্তে সে নিজে রিডিং পড়তে পারে তবে ইংরেজীতে এখনও কাচা। জালাল ইংরেজীর উপর খুব গুরুত্ব দিতে বলল শ্যামলীকে। ছয়টি মাস একঘন্টা করে শ্যামলীর পেছনে সময় ব্যায় করল জালাল। এর পর তার নিজের পরীক্ষার মনযোগী হয়ে উঠে। পরীক্ষা শেষ অতঃপর সে দশমশ্রেণীতে অধ্যায়নরত। ফোর এর বই শেষ করে শ্যামলী ফাইভের পুরাতন বইগুলি পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শ্যামলীর বয়স এগার'র কোটায়। এদিকে জালাল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হলে গ্রাম ছেড়ে তাকে শহরে চলে যেতে বাধ্য হতে হলো কারণ; তার নিজ এলাকায় কোনো কলেজ এখনো হয়নি। জালাল উঠে তার নিজের বাসায়। বড় ভাই কামাল অনার্স শেষ করে লন্ডনে পাড়ি জমায়। জালাল প্রতি মাসে একহাজার টাকা পায় বাবার কাছ থেকে। নিজ বাসায় থাকা খাওয়া আর বড় চাচার পরিবারের সাথে সে থাকে। বড় চাচা ছোট বেলা থেকে বাসায় থাকেন। জালালের চাচাতো দুই বোন সিলেট এমসি কলেজে পড়ে। একবোন ইন্টারে আর এক বোন ডিগ্রিতে। জালালের সমবয়সী রেখা তার ক্লাসমেট। একি কলেজে ইন্টামিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারে দুজন।.
রেখা খুবই সুন্দরী আর স্মাট। দুজন একসাথে কলেজে যাওয়া আসা করে। দুজনেরই বয়স বাড়ছে, বাড়ছে যৌবনের জুয়ারও। বাহিরের জগতের সাথে পরিচয় আর আধুনিক চালচলনের হাতছানি তাদের সামনে। উঠতি বয়সী দুজন। জালাল গ্রামের ছেলে আর রেখা শহরের মেয়ে। রেখা প্রতিনিয়ত জালালের খুব কাছে ঘেষতে চায়। যেমনটি একবার পরিচয় হলে শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে মনে হয় সম্পর্কটা বহুকালের নিকট আত্নীয়ে মত। রেখা যতই জালালের কাছে ভিড়তে চায় জালাল তত রেখাকে এড়িয়ে চলতে থাকে। জালালের অজান্তেই রেখা ভালবাসতে থাকে জালালকে কিন্ত জালাল আছে অন্য জগতে মজে। শহরে পড়ে থাকলেও সে দিবানিশি শ্যামলীকে নিয়ে ভাবে। বাবার দেয়া মাসিক একহাজার টাকা থেকে শুধু যাতায়াত খরছ মিটিয়ে বাকী টাকা সে জমা করে রাখে। বাড়ি এলে শ্যামলীর কাছে গোপনে দিয়ে যায়। তার রেখে যাওয়া পুরাতন বইগুলো মন দিয়ে পড়তে নির্দেশ করে জালাল শ্যামলীকে। শ্যামলীও প্রতি সন্ধ্যা এক ঘন্টা বইগুলো রিডিং পড়ে উলট পালট করে। শ্যামলী জালালের সেভেনের বইগুলো পড়তে না পড়তে তার আইএ পরীক্ষা শেষ হয়। রেখা জুকের মত টানছে জালালকে কিন্তু জালাল এক উদাসী বাউল যেন তার মনে মানবতার প্রেম ছাড়া আর কোনো প্রেমিকার স্থান নেই। তবে শ্যামলীকে জীবনের চেয়ে ও বেশি ভালবাসে সে। এ ভালবাসা তার ভাল লাগা থেকে শুরু। এক সাথে অনেকদিন বেড়ে ওঠা ইত্যাদি ইত্যাদি কারণ।.
শ্যামলীর বড় বড় চোখগুলো আর কুকড়ানো চুলগুলো তার খুব ভাল লাগে। মুক্তার মত দাঁত আর ডাগর ডাগর চাহনি, আনমনা ভাবা আর দুঃখে বিমূর্ষ মুখে একচিলতে বেঁচে থাকার প্রত্যাশাপূর্ণ স্বপ্ন মিলিয়ে শ্যামলীই তার জীবনে অপূর্ব এক মানবী। গায়ের রঙ কালো হলেও গঠন কাটামো দেখার মত। অনেক সুন্দরীকে প্রতিযোগীতায় নির্গাত পরাজিত করবে। ধনীর দোলালী হলে কিংবা সাজগোজ করলে আরো সুন্দর দেখাত। কাজের এতো চাপ সামলানোর পরও শ্রী'তে ভাটা নেই, দেখতে বার বার মন চায়। কাজ তাকে সামান্যতমও গিলে খেতে পারেনি। জালাল অনেক বার বলেছে তুমি সাবধানে থেকো শ্যামলী। সাবধানে থাকবে কেন শ্যামলীর উল্টো প্রশ্নের জবাবে জালাল বলেছে তুমি দিনদিন বড় হচ্ছো তাই। বাড়ির কাজের লোকগুলো বড্ড বদমাইশ লুইচ্চা। দেখোনা কেমন শরম বেশরমের কথা নিয়ে দিব্যি গল্প করে ওরা। দিনে দিনে বড় হচ্ছে শুনে শ্যামলীর খুব লজ্জা লজ্জা লাগল কথাটি। একটু মুচকি হাসি হেসে জালালকে বলল বড় হচ্ছি তো কি হচ্ছে, তুমি কি হচ্ছো না! শ্যামলী বলল, ওরা যতই বদমাইশ লুইচ্চা হোক না কেন আমাকে কেউ কিছুই করতে পারবেনা। খুব সাহস নিয়ে বুক ফুলিয়ে কথাগুলো বলল। শ্যামলীর সাহস দেখে জালাল হাসল। এর কিছুক্ষণ পর জালাল তার গন্তব্যে চলে যেতে চাইলে শ্যামলী পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলল শহরে কতো গাড়িঘোড়া তুমি সাবধানে থেকো। জালালের কানে এ কথাটি প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনি করে বারংবার। জালাল রেজাল্ট শেষে বাড়ি আসে। এ দুবছরে শ্যামলী আরো অনেক বড় হয়েছে। শহর থেকে জালাল এক সেট সালোয়ার কামিজ এনেছে শ্যামলীর জন্য। শ্যামলী এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারে।.
সে পরের ঘরে থাকে আর বান্দির মতো কাজকর্ম করে নিজ পরিবারের ভাতের যোগান দেয়। তারপর জালালের সাথে মিশতে গেলে লোকের মুখে কানাকানি। সবাই ফিসফিস করে বলে কালো চেহারাটা দিয়ে নাকি মেয়েটি জালালকে পাগল করে দিয়েছে ইত্যাদি। জালালও নাকি এ মেয়েটি ছাড়া চোখে আর কিছুই দেখতে পায় না। জালালের মা দিব্যি এমন কথা প্রকাশ্যে বলেন। শ্যামলী শুনে হজম করে শুধু পেঠের দায়। কর্তীর ঝাঁঝানো কথা এখন অসহ্য হয়ে গেছে। দিনভর ঝাড়ি খেতে কার ভাল লাগে কিন্তু শ্যামলীর হজম করা ছাড়া উপায় নেই। এতসব চিন্তা করে শ্যামলী জালালের দেওয়া জামাকাপড় গ্রহন করে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। জালাল জামা নিতে অস্বীকৃতির কারণ জানতে চায়। শ্যামলী সোজা সাপ্টা বলে আমি তোমার কে? ওটা আমাকে নিতে হবে কেনো? এটা নিলে লোকে কি বলবে তুমি কি তা জানো। জালাল বলল শ্যামলী - লোকে কি বলবে তা বুঝার মত জ্ঞান অবশ্য আমার হয়েছে। কে কি বলল তা তোমার বুঝার দরকার নেই, আমি অন্যের কথায় কান দিতে চাই না বরং আমি দিয়েছি তুমি নাও। তুমি আমার কে, সময় হলে তোমাকে বলব ধর্য্য ধরো এখনো সময় হয়নি। শ্যামলী জামাগুলো নিল সবার সম্মুখে। তা দেখে জালালের মা সামনাসামনি কিছু বলতে গেলেন না যদি ছেলে রেগে যায়। কিন্তু জালাল শ্যামলীর হাতে জামাটি দিয়ে বলল এটা তুমি পরো যদি কেউ কিছু বলে আমাকে জানিও।.
এর পর জালাল শহরে চলে গিয়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হল। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। শ্যামলীর শারিরিক গঠন পরিবর্তিত হচ্ছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। একবার তাকালে বোবারও যৌবনের ঘন্টা বাজে টং টং করে। খুব সতর্কতার সহিত শ্যামলীর সাথে কথা বলে জালাল বাড়ি এলে। এপর্যন্ত জালাল শ্যামলীকে জানিয়ে দিয়েছে সে তাকে খুব ভালোবাসে। শুধু ভালবাসা নয় তাকে বিয়েও করতে চায় জালাল। শ্যামলী কত কাকুতি মিনতি করে বারণ করেছে বুঝিয়েছে কত। বলেছে আকাশের গায়ে চাঁদ শোভা পায়, তুমি আকাশ তুল্য। আমি সাধারণ জংধরা মরিচিকা মাত্র। তা হয় না। আকাশ পাতাল ফারাক এ সমাজ মেনে নেয় না কখনো। তুমি আবেগে মেনে নিলেও তোমার পরিবার কোনো বান্দিকে পুত্রবধু হিসাবে মেনে নিবে না। জালাল এতো কথা শুনতে চায় না শ্যামলীর। একটাই তার শেষ কথা বিয়ে যদি করে তাহলে সে শ্যামলীকেই করবে। না হলে আইবুড়ো থাকবে জনমভর। জালালের কথায় শ্যামলী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো আমার কপালে কি এত সুখ সইবে। জালালের দৃঢ়কণ্ঠের উত্তর সেদিন শ্যামলীকে যুগযুগ প্রেমের টানে কুমারী থাকার প্রেরণায় উৎসাহী করে তুলে। বিনোদিনী হলেও সে প্রেম করতে বা জালালের অপেক্ষা করতে কোনো ক্ষতি নেই তার। প্রেম দুজনের জীবনে এই প্রথম এলো। অনেক বুঝাপড়া করে শ্যামলী সায় দিয়েছে। দুজনের মধ্যে অনেক জানাশোনা বিধায় এ প্রেম ভাঙ্গার ভয় খুব কম। হুট করে করা প্রেম হুট করে ভেঙ্গে তচনছ হয়ে যায়।.
শ্যামলী নিজে নিজে দশম শ্রেণী পাশ করে। আস্ত যুবতি সে। মা বাবা আর পরের বাড়িতে কাজে যেতে দিতে চান না কিন্তু কোনো উপায় নেই। এদিকে জালালের বড় ভাই লন্ডন ফেরত হয়ে দেশে এসে বিয়ের পিড়িতে বসেন। বিয়ে উপলক্ষ্যে গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন কাটায় জালাল। মা বাবা ভাই বোন মিলে জালালের পড়া নিয়ে কথা উঠে সন্ধ্যার আড্ডায়। সে সোজা সোজি বলেছে মাস্টার্স শেষে থামবে। হাবিবা বলে উঠে তখনই আবার নতুন ভাবি আসবে এইতো। জালাল শাসনের সুরে ধমক দেয় খুব পেঁকে গেছো তাই না, নিজের চরকায় তৈল দাও। একটু মজা করে বলল চল্লিশের আগে বিয়ে দিচ্ছি না। ভাইয়ের কথায় খুব লজ্জা পেয়ে হাবিবা অন্যত্র চলে গেল। শ্যামলী রান্না ঘর থেকে কান পেতে আলোচনা ফলো করছিল। মাস্টার্স! আরো কতো দিন অপেক্ষা করা! না আমি পারবনা মনের সাথে কথাগুলো বলে শ্যামলী। ভাবে- গরীব ঘরের মা বাবাতো এতো সময় দেরি করতে চান না। বিয়ের বয়স হলো আর আলাপ এলেই বিয়ে দিয়ে ফরজ আদায় করে হন ক্লান্ত। যাই হোক আগাম টেনশন করে লাভ নেই যা হবার সময়ই বলে দেবে। জালাল শহরে গেল চলে। নির্ধারিত সময়ে তার মাস্টার্স কমপ্লিট হলো। বিয়ের আলোচনা চলছে জোরেসুরে। অন্যত্র পাত্রী দেখতে হল না বরং চাচাতো বোন রেখার জন্য চাচা নিজেই প্রস্তাব করে বসেন। জালালের মা বাবারও মত; রেখাকে পুত্রবধু করার। কিন্তু জালাল রেখাকে বিয়ে করবেনা সাফ জানিয়ে দেয় সবাইকে এবং এও বলে দেয় যদি বিয়ে করে কখনও তা হলে শ্যামলীকেই করবে।.
কথাগুলোতে দৃঢ়তার স্পষ্টতা দেখে সবাই অনুমান করলেন তার সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যাবেনা এবং বৃথা চেষ্টা করে লাভ হবে না। জালাল এও বলেছে সে শ্যামলীকে খুব ভালোবাসে। কিছুই করার নেই শুনে সবাই থ হয়ে গেলেন। কিন্তু তার মায়ের চেহারায় আগুনমুর্তি ধারণ করল। জালালের গালে ধপাস করে এক থাপ্পড় মেরে বললেন তুই এতো নিচে নেমে গেছিস যে শেষ পর্যন্ত আমার ঘরের বান্দিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। তবে শুনে রাখ্ আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না। এ ঘরের বউ হিসাবে বান্দির হাতে মেহেদী উঠতে দেবনা। জালালের সামন থেকে রান্না ঘরের দিকে দ্রুত গিয়ে টান তিনি দিয়ে শ্যামলীর হাতে ধরলেন। গলা ফাটিয়ে বললেন বাদির ঘরের বাদি বেরিয়ে যা এমহুর্তে এখান থেকে। এ বাড়িতে এক মহুর্ত থাকার আর স্থান নাই তোর। এতক্ষণ জালাল দাড়িয়ে সব দেখছিল আর রাগে খুব জ্বলছিল। জালাল এবয়স পর্যন্ত কোনো দিন রাগেনি। আজই প্রথম। চোখ ভিজিয়ে শ্যামলী ধীরে ধীরে তার বাড়ির পথ ধরে হাটতে লাগল। এভাবে শ্যামলীকে বের করে দেওয়া হবে সে কল্পনাও করেনি কোনো দিন। সে আর কি করবে; দুই মিনিট দাড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে শ্যামলীর অনুস্মরণ করতে পা বাড়ালো ঘরের বাহিরে। গতি বাড়িয়ে পৌছালো শ্যামলীর পাশাপাশি।.
শ্যামলীর একটি হাত বন্ধি করলো তার নিজের হাতের মুষ্টিতে। ঘর আর বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা জালালের মা বাবা ভাই বোন সবাই চেয়ে চেয়ে শুধু দেখলো। দুজন বেরিয়ে গেলে কেউ ফেরানোর চেষ্টা করল না। নিজের মত করে জালাল শ্যামলী ভালবাসার ঘর বাধলো অন্যত্র। জালালের পরিবার আর কোনো দিনও তাদের গ্রহন করেনি। কারণ শ্যামলী কাজের মেয়ে দাসীবাদির সমতুল্য তাই। চাকর বাকরকে পুত্রবধু হিসাবে স্থান দিলে লোকে লজ্জা দেবে, কমবে তাদের আভিজাত্যের অহংকার যেটা তাদের ধারণা। আভিজাত্য আর উচু তলার বাসিন্ধাদের একটু খামখেয়ালীর জন্য এভাবে কতো নাড়ির চেদন ও আপনজন ঘর হারা হয় তার হিসাব এ সমাজে কি রাখার দরকার, জবাব দেবে কি সমাজ। কি অপরাধ ছিল জালালও শ্যামলীর? তবে জালাল আর শ্যামলী উচুনিচুহীন একটা ভালোবাসার ঘর বেধেছে চিরদিনের জন্য। মা বাবা তাদের মান সম্মান নিয়ে থাকুক মানুষ মানবতাকে গলাটিপে হত্ত্যা করে তাতে জালাল শ্যামলীর ও কিছু যায় আসে না।.
জালাল ভাল করে জানে ধনে জনে আভিজাত্যে প্রকৃত মানুষ নয়, যেমনটি ভাল পোষাক পরলে ভদ্রলোকের তালিকায় গন্য হওয়া যায় না। ভদ্রলোক সেই যার ব্যবহার উত্তম। অনেক ভেবে জালালও সিদ্ধান্ত নিয়েছে মা বাবা কেন পৃথিবীর যত মানবতাহীন মানুষ আছে তাদের সাথে কোনো দিনও মিশবেনা আপোষ করবে না। একজন অসহায় নারী সহায় পাবে, একটি গরীব পরিবারের বোঝা কমবে যদি সে শ্যামলীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারে। ভালবাসার চেয়ে এ ভাবনাটি বেশি কাজ করেছে জালালের বিবেকে। বিবি সাহেব, দাসদাসী, গোলাম বলতে কিছু নেই এ জগতে বরং মানুষ সবাই সমান। ধনী গরীব সবাই মানুষ, তাই মানুষেরা মর্যাদা পাক, একথাটি জালালের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে ভাবে মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাড়াবে এটাই তার মানবিক ধর্ম। ভাবে সুন্দরী মেয়েকে সবাই ভালোবাসে তার পিছনে লাইন ধরে তা কেনো, অথচ কালোরা কি অধরা? নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ তার, দাসীবাদির তারতম্য রুখে শ্যামলীর হাতে মেহেদী পরিয়ে মানবিক কাজটিই সে করতে পেরেছে। বলছিলো শ্যামলীকে বাসর রাতে গল্প করে। জালাল আর শ্যামলীর যুগল বন্ধন আজীবন ছিল সুখে ভরপুর।. .
ডে-নাইট-নিউজ / মো. সায়েস্তা মিয়া
আপনার মতামত লিখুন: