৩ টাকার আটা ( ১ম পর্ব).
প্রথমে জীবনের সূচী দিয়ে বলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি কিন্তু পড়বে আজ কয়জন? কি হতে চেয়ে কি হয় তা ভাবা যায় না।বলার ক্ষেত্রে অনেকটা জীবনের কঠিন বাস্তবতা হলেও দীর্ঘ পরিসর পড়ার সময় নেই যান্ত্রিক এই সময়ে। তিন যুগ আগে যেখানে হাতে হাতে আধুনিকতা ছিলনা তখন মানুষের কাছে পাঠনের উপলক্ষ ছিল পেপার পত্রিকা বই পুস্তক। মানুষ জ্ঞান অর্জনে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে খবরের কাগজ পড়তো এবং তা থেকে উপকৃত হত কিন্তু সমস্ত বিশ্ব যখন আপনার আমার হাতের মুঠোয় এখন আর লম্বা লম্বা লেখনি পড়ার সময়টুকু যেন অথই পাতারে ডুবে মরে গেছে আমাদের। তদাপী আমার এই লম্বা লেখনিও কেউ পড়বে না পড়তে চাইবেনা কারণঃ আমি নাই বললাম। ভুমিকা আর লম্বা না করে আসল কথায় আসি। ৩ টাকার আটা - আজ থেকে তিন যুগ আগে যার কেজিদর ছিল। বলছি ১৯৮৬-৮৭ সালের কথা। সময় গড়িয়েছে যতখানি সেই আটার দাম পেরিয়েছে ৫০ টাকা অংকের ঘর। যে আটা ছিল নিম্ন আয়ের মানুষের সোহাগি সোনা তা আজ উচ্চবিত্ত সমাজের হয়েছে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ঔষধের পাশাপাশি ধনী দারিদ্র্যের ভিন্ন প্রকার মুখরোচক খাবারের উপকরণ। সময় যত এগিয়েছে, আধুনিকতার পরশ যত লেগেছে সভ্যতায় ততো বেড়েছে খাদ্য সামগ্রীর আকাশছোঁয়া দাম। দাম বাড়ার কারণ -যোগ হয়েছে বৈশিক মহামারী - যুদ্ধ- বিগ্রহ ইত্যাদি। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এখন সাধারণ মানুষের ধারে কাছে ও নাই। ৩ টাকার আটা এখন ৫৫টাকায় কেমনে কিনে খাই এ নিয়ে আমার শঙ্কিত মানসপট অনেকটাই দিশেহারা। নব্বইয়ের দশকে যেসকল খাদ্য সামগ্রী নাগালে থাকার পরও নিম্ন আয়ের মানুষ খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছে, এখন যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তারা ৫৫ টাকায় আটা কিনে কিভাবে খায় তার হিসেব কে করে খোঁজে পাওয়া যায় না। আমি যখন ৮ বৎসর বয়সে খরচাপাতি করার পারিবারিক তাগিদে হাটবাজারে যেতাম সে সময়ের জিনিসপত্রের দাম এখনও আমার মুখস্থ। ৭ টাকায় ছিল কেরোসিন, ৬টাকা ছিল চালের কেজি আর ১০-১২ টাকায় ছিল ইলিশ। কালেভদ্রে ইলিশ খাওয়া ছাড়া আগে যেমন জমিদারি পয়সা ছিলনা তেমনি এখনও নেই। এখনতো ইলিশ স্বপ্নের হরিণ। এখন বৌ রয়েছে, ছেলে মেয়ে হয়েছে, রয়েছে ভাই বোন নিয়ে সংসার, তবে টাকার মেশিন স্থবির হয়ে আছে আজন্মকাল। বুকের বাম অলিন্দে জীবনভর অপূর্ণতা আছে যা কেউ জানার তাগিদ মনে করেনি আর করবে কতজনের? আমি কি এদেশে এঁকা, আমি কি একাই নিম্নবিত্ত! জীবন যুদ্ধে আরো কত আমি যে হায় হায় করছে সবার খবর নেওয়ার মত কার এতো দায় পড়ে। এদেশে মাথা বিক্রি করলে গোলামীর সনদ পাওয়া যায় অথচ পেটে ভাত জুটানোর রাস্তা পাওয়া চরম মুশকিলের কাজ। .
.
তিনযুগে দ্রব্যমূল্যের দরদাম আকাশ পাতাল বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে বহুগুণ, সাথে মানুষের জীবন হয়েছে উন্নত। মানুষের মধ্যে তিনটি শ্রেণির অঘোষিত লকব সংযোজন হয়েছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত লকবে ভাগ হলেও এমনটি হওয়ার কথা ছিলনা। একমাত্র পূঁজিবাদি সমাজে মানুষের মাঝে শ্রেণিবৈষম্য প্রতিষ্ঠা পায়। আমার কাছে যা প্রতিয়মান হয় তা হলো ধনী আরো ধনী হচ্ছে, হবে - মধ্যবিত্ত ধনের পেছনে ঘোড়ার মত দৌড়াদৌড়ি করছে আর নিম্নবিত্ত কোন উপায় দেখছে না চোখে। .
.
১৯৮৬ সালে আমার পরিবারটি একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল। হঠাৎ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমার পুরো পরিবার পুরুষশুন্য হয়ে পড়ে। কুড়ি জন মানুষের পরিবারে এক বিকট আঁধার নেমে আসে যা কেউ কোনদিন কল্পনা ও করেন নাই। বাপ-চাচা পাঁচজনই জেলে চলে যেতে হয়। পূর্ব পুরুষের তালুকদারী সম্পদ নিয়ে বিরোধের জের একটা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারকে অস্বচ্ছল নিন্মবিত্তে রূপান্তরি করে এক নিমিষেই। তখন আমার বয়স মাত্র ৬ বছর। বাপ-চাচা বিহীন পরিবারে আমি একমাত্র সবার বড় ছেলে। সে হিসেবে অন্যের হাত ধরে হাটে-বাজারে গিয়ে সদাই-পাতি যোগাড়ের দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়ে না চাহিতে। চাষের জমি থেকে পরিবারের ভাতের যোগান আর বাড়ির গাছ-গাছালি বিক্রি ও বাঁশ হতে চাটাই বিক্রি করে হতো তরিতরকারি মশলা-পাতি যোগাড়। আত্মীয়-অনাত্মীয়দের সাহায্য ও দানে চলতে থাকে আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এককথায় সেই যে সূর্য ডুবেছিল আর এখনোও ঊষা দেখার পথ প্রচ্ছন্ন হচ্ছে না। এরিমধ্যে কত উজান-ভাটি হয়েছে জীবনে তার হিসেব বলে কাকে কি বুঝাই। এজগতে দুঃখের কথা শুনার মানুষের বড়ই অভাব। আবার আপনি যদি নিরেট সত্যি কথা এবং প্রবাহমান জীবনের গল্প বলেন তা শুনে অনেকেইর হজম হয় না, অনেকেই করেন অপ্রিয় সমালোচনা। তবে আমি সমালোচনা পছন্দ করি কিন্তু সমালোচক হতে চাই না। ১৪ জন মানুষের সদাই-পাতির ব্যাগ আমি ৬ বৎসরের শিশুর কাঁধে পড়ে কারণ ; আমি তখন পরিবারের বড় ছেলে। স্মৃতি যদি বেঈমানী না করে তাহলে চলমান জীবনের সাথে চলমান সমাজের পরিবর্তনের খুটিনাটি অনেক কিছুই লিখতে পারব তবে এতো পড়ার সময় এখন আর অনেকেরই নেই। কারণ; তথ্য প্রযুক্তির যুগে সবাই এখন যান্ত্রিক, সময় কমে গেছে, ব্যস্ততা বেড়ে গেছে । ১ যুগ আগে মানুষ খবরের জন্য পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশন নির্ভর ছিল। এখন ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়ায় বিনোদন সহ সব কিছু হাতের মুঠোয়, হয়ে পড়েছে ফেসবুক কেন্দ্রিক।.
.
আমি নিজে যখন পত্রিকায় লিখতাম তখন সেই পত্রিকা সংগ্রহ করে এনে সংরক্ষণ করে রাখতাম। পত্রিকা পড়া একটা নেশা হয়ে দাড়ায় আমার। নির্দিষ্ট সময় নিয়ে টেলিভিশনে খবর দেখা একসময় রুটিনের কাজ হয়ে পড়ে এবং না দেখলেই যেন পেটের ভাত হজম হত না। খবর পড়তে পড়তে একসময় খবরের কাজ( সাংবাদিকতা) করার আগ্রহ চেপে বসে আমার ঘাড়ে। ২০০৩ সালে ঢাকার একটি পত্রিকা দিয়ে সংবাদ প্রেরণের কাজ শুরুও করে দেই। সেই থেকে সাংবাদিকতা নামের পেশার সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু কতটুকু সাংবাদিক হতে পেরেছি তা আমি জানি না। স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক বাংলা গণমাধ্যমে মুক্ত কলাম, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প অনেক লিখেছি। একসময় তা সংগ্রহ করে রাখতাম। সংগ্রহের তালিকায় এখন কাঁচা হাতের কিছু আর্টিকেল শুধু আছে বাকী সব খেয়ে নিয়েছে ২০২২ সালের ভয়ানক বন্যা ও এর আগের প্রাকৃতিক ঝড়-ঝাপটা। আর যখন থেকে লেখনিগুলো অনলাইন পত্রিকা ও ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রকাশিত হতে লাগল তখন থেকে আর সংরক্ষণ করার চিন্তা মাথায় আসেনা। .
.
পরিবারের ঘানিতে ঘষতে ঘষতে আমার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যায় মাধ্যমিকেই। সোনালী ছোটবেলা আমার কাছে অজস্র বিষাদের স্মৃতি। ৩ টাকার আটা আজ যখন ৫৫টাকায় তখন আরো কঠিন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে পড়ছি রোজ রোজ। মাধ্যমিকে লেখাপড়া বন্ধ হলেও আমার পাঠশালা হয়ে উঠে খবরের কাগজ আর অন্যান্য শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক। লেখা পড়ায় প্রচন্ড আগ্রহ আমাকে আবার ও পাঠশালার আঙ্গিনায় দাঁড় করায় ২০১৩ সালে। দেখতে দেখতে ২০১৭ সালে এসে আমি এসএসসি পাস করি। ২০১৯ সালে পাস করি এইচএসসি। ২০২০ সালে বি.এ, বিএসএস প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে ৪র্থ বর্ষে আছি যদিও পড়ার বয়স এখন নাই কিন্তু " লেখাপড়ার বয়স নাই, চল মোরা পড়তে যাই" এ কথা-ই আমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগাচ্ছে।.
.
কথার প্রসঙ্গে নিজ জীবনের ঘটনা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছে যা বলতে আমার একটুও দ্বিধাবোধ নেই। না থাকার কারণ হচ্ছে এঁরি সাথে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা জড়িত রয়েছে। যখন ৩ টাকায় এক কেজি আটা কিনে এনে আমার পরিবারে আহার করতাম তখন অনেকেই ৩ টাকায় আটা কেনার ক্ষমতা রাখত না। মানুষের আহার সম্পর্কীয় দূর্দশা, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের চাহিদা পূরণের আকাঙ্খা প্রাচীনতম। এর সাথে সম্পর্কীয় রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মুক্তি। .
(চলবে).
ডে-নাইট-নিউজ / মো. সায়েস্তা মিয়া ( লেখক)
আপনার মতামত লিখুন: